
সুনামগঞ্জের ধোপাজান-চলতি নদী বালুমহালে খননযন্ত্র (ড্রেজার) ও বোমা মেশিন দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। এতে নদীর তীরের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
ইজারার নীতিমালা অনুযায়ী, ড্রেজার ও বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চলতি নদীর সীমান্তবর্তী ডলুরা এলাকায় ৩৭১ একর জমি নিয়ে ধোপাজান-চলতি নদী বালুমহালের অবস্থান। মহালটির ১৪১৯ থেকে ১৪২১ সন পর্যন্ত ইজারাদার ছিলেন তফাজ্জল হোসেন। এ বছরের ১৩ আগস্ট উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় তফাজ্জল হোসেনের কাছ থেকে আবার ১৪২২ বাংলা সনের খাজনা হিসেবে ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬২১ টাকা নেয় জেলা প্রশাসন। কাগজপত্রে ইজারাদার হিসেবে তাঁর নাম থাকলেও মহালটি নিয়ন্ত্রণ করেন সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী জিয়াউল হক।
গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, চলতি নদীর জিনারপুর এলাকা থেকে একেবারে সীমান্তের ডলুরা পর্যন্ত ড্রেজার ও বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বেশির ভাগ নৌকার সঙ্গে একটি করে ড্রেজার রয়েছে। এসব ড্রেজার দিয়ে নদীর ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে বালু তোলা হচ্ছে।
আদাং ও ডলুরা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নদীতে দুই শতাধিক ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। পানি বেশি থাকায় বোমা মেশিনের সংখ্যা কম। ভোর থেকে শুরু হয়ে রাত আটটা পর্যন্ত বালু উত্তোলন চলছে। প্রশাসন এসব যন্ত্র বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়। তখন দু-এক দিন বালু উত্তোলন বন্ধ থাকে। পরে আবার শুরু হয়।
সুনামগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক দেবজিৎ সিংহ বলেন, ইজারা নীতিমালা অনুযায়ী সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মহাল থেকে বালু তোলা যাবে। তবে বালু উত্তোলনে কোনো বোমা মেশিন বা ড্রেজার ব্যবহার করা যাবে না।
বালু উত্তোলনের কাজে জড়িত কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ বাল্কহেড বালু উত্তোলন করা হয়। এর একেকটিতে এক থেকে দুই হাজার ফুট বালু ধরে। মহাল থেকে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ লাখ ফুট বালু উত্তোলন করা যায়। প্রতি ফুট বালুর জন্য টোল হিসেবে ইজারাদার পান ৭০ পয়সা। সুরমা নদীতে নিয়ে আসার পর জাহাজে করে এসব বালু দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়।
তবে শ্রমিকদের দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করলে সময় ও অর্থ বেশি লাগে। শ্রমিকেরা হাতে এক হাজার ফুট বালু উত্তোলন করে নৌকায় ভরে দিতে সময় নেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এ জন্য তাঁদের দিতে হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে বোমা মেশিন বা ড্রেজার দিয়ে এক হাজার ফুট বালু উত্তোলন করতে সময় লাগে মাত্র আধা ঘণ্টা। প্রতি ফুটে লাগে এক টাকা। এ কারণেই ব্যবসায়ীরা বোমা মেশিন ও ড্রেজারে বেশি আগ্রহী।
আদাং গ্রামের একজন শ্রমিক বলেন, প্রশাসনের লোকজন অভিযানে আসার আগেই এলাকায় খবর চলে আসে। এ কারণে কর্মকর্তারা আসার আগেই অনেকে মেশিন সরিয়ে নেন।
ডলুরা গ্রামের বাসিন্দা আফাজ উদ্দিন বলেন, মেশিন দিয়ে বালু তোলায় নদীর তীরের বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বালুমহালের ইজারাদারের পক্ষে জিয়াউল হক বলেন, ‘নদীতে একসময় বোমা মেশিন ও ড্রেজার ছিল। এখন নেই। নদীতে পানি বেশি থাকায় শ্যালো মেশিন দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে বালু তোলা হয়। এসব মেশিনে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। প্রশাসন থেকে বলার পর আমরা সব নৌকামালিক ও ব্যবসায়ীকে বলে দিয়েছি, বোমা মেশিন বা ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা যাবে না।’
আদাং গ্রামের জহির মিয়া নামের এক শ্রমিক জানান, দুই উপজেলার অনন্ত পাঁচ হাজার শ্রমিক বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন বোমা মেশিন ও ড্রেজার দিয়ে বালু তোলায় তাঁরা অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, এই নদীতে বোমা মেশিন ও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধের বিষয়ে উচ্চ আদালতে বেলার একটি মামলা রয়েছে। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক দেবজিৎ সিংহ বলেন, ‘ওই নদীতে আমাদের নিয়মিত অভিযান হয়। বোমা মেশিন বা ড্রেজার থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’