খুনোখুনির বৃত্তে নরসিংদী

লোকমান হোসেন, বিল্লাল হোসেন, মাহমুদুল হাসান, রাহাত সরকার
লোকমান হোসেন, বিল্লাল হোসেন, মাহমুদুল হাসান, রাহাত সরকার

নরসিংদীর শিবপুরের সাবেক সাংসদ রবিউল আলম ওরফে কিরণ খাঁকে ১৯৮৬ সালের ২৮ এপ্রিল রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রভাবশালী এই রাজনীতিক হত্যার বিচার পেতে তাঁর পরিবারকে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। ১৮ বছর আইনি লড়াইয়ের পর ওই মামলায় একজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তবে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগেই দণ্ড পাওয়া ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

কিরণ খাঁর পরিবার তবু একটা সান্ত্বনা পেয়েছিল। কিন্তু নরসিংদীর অধিকাংশ খুন হওয়া রাজনৈতিক নেতাদের পরিবারগুলো বিচার না পাওয়ার কথা বলেছেন।

গত বৃহস্পতিবার নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে খুন হন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। সেই হত্যাকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহের জন্য নরসিংদী গিয়ে কথা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, এসব খুনের বিচার না হওয়ার কারণে এমন প্রবণতা বাড়ছেই।

স্বাধীনতার পর নরসিংদীতে কতজন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তার সংখ্যা পাওয়া গেল না। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখন পর্যন্ত জেলার দুজন সাংসদ, পৌরসভার মেয়র, এক ডজনের বেশি ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, পাটকলের শ্রমিকনেতা, সমবায় নেতা, নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত নেতাসহ রাজনৈতিক নেতারা খুন হয়েছেন।

নরসিংদী শহরে ৩৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন সরকার আদম আলী। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে রয়েছে মাদক ব্যবসা, দখল ও দলীয় কোন্দল। যদি একটি হত্যাকাণ্ডেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তবে এত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না বলে তিনি মনে করেন।

নরসিংদীর আইনজীবী কাজী নজরুল ইসলাম মনে করেন, বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা ও অসাধুতার কারণে বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার কারণে এ ধরণের খুন বাড়ছে।

হানাহানির ইতিবৃত্ত

আশির দশকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সাংসদ কিরণ খাঁ যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য, বাকশাল গঠনের পরে জেলার যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর ভাই হারুণ খাঁ এখন শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের মামলা তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছিল সিআইডি। সেখানে তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর পরিবার নারাজি দেয়। একপর্যায়ে এর বিচার বিভাগীয় তদন্তও হয়। শেষ পর্যন্ত ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। চূড়ান্ত বিচারে ১১ জন খালাস পান। একজনের ফাঁসির সাজা হয়। তিনি অবশ্য ফাঁসি কার্যকরের আগেই মারা যান।

হারুণ খাঁ বলেন, ভাইয়ের হত্যা মামলার বিচার পেতে তাঁরা ঢাকা থেকে আইনজীবী নিয়ে গেছেন নরসিংদীর আদালতে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক নরসিংদীতে গিয়ে মামলা লড়েছেন।

এতখানি ধৈর্য আর লেগে থাকার সামর্থ্য সব পরিবারের থাকে না। যেমন মামলা নিয়ে হতাশ ছাত্রদল নেতা বিল্লাল হোসেন রনির স্বজনেরা। ২০১০ সালের ১৫ মার্চ নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদ কার্যালয়ের ভেতরেই গুলি করে হত্যা করা হয় ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) বিল্লালকে। নিহতের বড় ভাই আবুল ফজল ওই ঘটনায় ১৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছিলেন। মামলায় গ্রেপ্তার সবাই এখন জামিনে। আবুল ফজল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির মধ্যে সে সময় অন্তঃকোন্দল ছিল। এটি প্রতিপক্ষ কাজে লাগিয়েছে। তিনি বলেন, আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এখন তাঁদের পরিবারকে চাপে রেখেছেন। আর তাঁদের ভয়ে সাক্ষীরাও আসছেন না।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেনকে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের ভেতরে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ড সারা দেশে আলোড়ন তোলে। ওই মামলার আসামিরাও সবাই জামিনে।

২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়ন পরিষদের ছয়বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক সরকার খুন হন। নিহত রাজ্জাক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। নরসিংদী বাজারেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পেছনেও আধিপত্য বিস্তার এবং দলীয় কোন্দলকে দায়ী করা হয়। নিহতের ছেলে (মামলার বাদী) এবং আলোকবালী ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ওই হত্যা মামলায় ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। এখন আসামিরা সবাই জামিনে। তিনিও মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান।

গত বছরের ৬ মে যুবলীগ কর্মী ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী রাহাত সরকারের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় নিহতের বোন জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এস এম কাইয়ুমকে আসামি করে মামলা করেন। তবে স্থানীয় ও পরিবারের সূত্রগুলো বলছে, রাহাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। বিষয়টি স্বীকার করেনি পুলিশ।

চলতি বছরের ২৬ মার্চ স্থানীয় যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হাসানের লাশ উদ্ধার করা হয়। নরসিংদী পৌরসভার উল্টো পাশের একটি ভবনের ১৬ তলায় তাঁকে নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ অন্য জায়গায় ফেলে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনাতেও শহরের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের হাত রয়েছে বলে মনে করছে তাঁর পরিবার।

হত্যার পেছনে থাকা প্রভাবশালীরা আইনের আওতায় আসেন না বলে অভিযোগ আরও তিনটি পরিবারের।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পুলিশকে বলে দিয়েছি যত প্রভাবশালীই হোক, প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবেই এসব অপরাধ কমবে।’ তিনি বলেন, শিবপুরের সাংসদ কিরণ খাঁ, পৌর মেয়র লোকমান হোসেন কিংবা বাঁশগাড়ীর সিরাজুল চেয়ারম্যানসহ এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আধিপত্য বিস্তারের জন্য হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবেই এর প্রতিকার করতে হবে।