গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে, ইয়াবাও আসছে

হাজি সাইফুল করিম। সরকারের ঘোষিত বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সিআইপি তিনি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা—সবার সঙ্গেই তাঁর মেলামেশা। কক্সবাজার জেলা পুলিশের করা ইয়াবার গডফাদারদের তালিকায়ও তাঁর নাম এক নম্বরে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে আসা মোট ইয়াবার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ আসে সাইফুলের মতো পাঁচ থেকে ছয়জনের মাধ্যমে। তাঁদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ আবদুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমান ছাড়াও আছেন নুরুল হক ওরফে ভুট্টু, শাহজাহান আনসারী, মোস্তাক আহমেদ, নুরুল হুদা, জাফর আহমেদ। তাঁদের মাধ্যমে ইয়াবা আসার পর সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

ইয়াবা একমাত্র মিয়ানমার থেকে আসে এবং এর বেশির ভাগ কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে।

দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে ৫৫ দিনে দেড় শতাধিক সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ২২ হাজারের মতো। কিন্তু সাইফুল করিমের মতো বড় ইয়াবা কারবারিরা কেউ গ্রেপ্তার হননি। আবার এত কঠোর অভিযানের মধ্যেও ইয়াবা আসা বন্ধ হয়নি। পুলিশের কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করে বলছেন, সাইফুল করিমকে ধরতে পারলে দেশে ইয়াবা আসা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে।

এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় অভিযানে তাহলে কারা ধরা পড়ছেন? গত ২৬ মে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার সময়ের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড প্রকাশের পর চলমান ক্রসফায়ারের যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মাদকবিরোধী দিবসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অভিযান যথেষ্ট পরিমাণে সাড়া জাগিয়েছে। এতে মানুষের সমর্থন রয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযান চলছে ও চলবে।

সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা কমবেশি ৭০ লাখ। তাঁদের অধিকাংশই ইয়াবায় আসক্ত। গত বছর দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলে চার কোটি ইয়াবা উদ্ধার করে। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির মত অনুযায়ী, মাদক উদ্ধার হয় সাধারণত মোট ব্যবহারের ১০ শতাংশের মতো। সেই হিসাবে বছরে শুধু ইয়াবা বড়ি বিক্রি হয় ৪০ কোটির বেশি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি বড়ি গড়ে দেড় শ টাকা ধরে)। যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের হিসাবে বছরে দেশে ইয়াবা বিক্রি হয় ১০ হাজার কোটি টাকার।

পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, এই বিপুল টাকার শক্তিতেই ইয়াবা ব্যবসা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ বা শূন্য সহনশীলতা নীতি ঘোষণা করলেও এখনো মাদকের রাশ টেনে ধরা যায়নি।

অক্ষত ইয়াবার রাজধানী

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, টেকনাফ-কক্সবাজারের কিছু স্থানীয় ব্যক্তির কাছে ইয়াবা আর দশটা ব্যবসার মতোই স্বাভাবিক রোজগারের উপায়। এই ব্যবসা করে কেউ কেউ টেকনাফের বিভিন্ন পাড়ায় আলিশান বাড়ি করেছেন। ব্যবহার করছেন পাজেরো, প্রাডোর মতো দামি গাড়ি। অথচ তাঁরা একসময় দরিদ্র জেলে কিংবা সাধারণ লবণচাষি ছিলেন।

সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া কক্সবাজারের এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর তথ্যমতে, সাইফুল করিমদের মতো ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক মিয়ানমারেও বিস্তৃত। তাঁদের কাজ কেবল ইয়াবা বড়িগুলো বাংলাদেশের ভূমিতে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া এবং ঘাটের নিরাপত্তা দেখা ও প্রশাসনকে হাতে রাখা। ইয়াবা আসার পর ‘ডিলারের’ লোকজনই চালান খালাস করে নেন। মাঝখান থেকে ইয়াবাপ্রতি পাঁচ টাকা করে কমিশন কেটে রাখেন ‘গডফাদাররা’। এ রকম গডফাদাররা সপ্তাহে চার থেকে পাঁচটি চালান নিয়ে আসেন। প্রতি চালানে ৫ থেকে ১০ লাখ ইয়াবা থাকে। ‘ঘাট খরচ’, ‘প্রশাসন খরচ’ সব বাদ দিয়ে গড়ে তাঁদের সাপ্তাহিক আয় কোটি টাকার ওপরে। এরপরের ধাপে আসে টেকনাফের ডিলাররা। যাঁরা ইয়াবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ মিলিয়ে এ রকম অন্তত দেড় শ ডিলার আছেন। টেকনাফের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, টেকনাফে ৩০ টাকার ইয়াবা ঢাকায় আসতে আসতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দাম হয়ে যায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ও অতিরিক্ত উপকমিশনার পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইয়াবার টাকা পুলিশ, বিজিবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে চলে যায়। তবে মাঝেমধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে কিছু নিম্নমানের ইয়াবা জব্দ হয়। কোনো কোনো বাহিনী পরিত্যক্ত অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা উদ্ধারও দেখায়।

ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত, শীর্ষ ব্যবসায়ী কারা, কোথায় তাঁদের অবস্থান, কোন পথে ইয়াবা ঢুকছে দেশে—সবই স্থানীয় প্রশাসনের জানা। ওই কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ইয়াবার ‘রাজধানী’ টেকনাফ-কক্সবাজার প্রশাসন ঠিক না হলে এর চোরাচালান বন্ধ হবে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, সারা দেশে ১৫ হাজারের কিছু বেশি মাদক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁদের নামে মাদকের একাধিক মামলা আছে। তাঁদের মধ্যে বড় মাদক ব্যবসায়ী আছেন তিন হাজারের মতো। সারা দেশ থেকে পুলিশ এসব ব্যবসায়ীর তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ১০ হাজারের মতো মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তালিকা ধরে তাঁদের গ্রেপ্তারে আরও অভিযান হবে বলে জানা গেছে।

যদিও ৪ মে থেকে শুরু হওয়া অভিযানটি পরিচালিত হচ্ছিল দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার করা তালিকার ভিত্তিতে। কিন্তু এ তালিকার কতজন ধরা পড়েছেন, সেটি এখনো স্পষ্ট করা হয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান শুরু পর বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এ কারণে তাঁদের ধরা যাচ্ছে না।

যেভাবে অভিযান চলছে, তাতে আদৌ বড় মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়বেন কি না, তা জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, অভিযান আরও চলুক, তারপরে বলা যাবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত সারা দেশে ২২ হাজার মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৯৩৩টি।

জানতে চাইলে র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মাদক পরিস্থিতি সহনশীল পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। মাদক সমস্যা এক দিনের নয়, এটা রাতারাতি দূর করাও সম্ভব নয়। এ জন্য সময় নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

এখনো ইয়াবা আসছে

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, এত অভিযানের পরেও নাফ নদী ও সাগরপথে এখনো ইয়াবার চালান আসছে। টেকনাফ থেকেই তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তের নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিদিন ছোট-বড় ইয়াবার চালান ধরছে। কিন্তু মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় মাদক পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না।

টেকনাফ ২ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জমাদার প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার থাকার কারণে এখনো ইয়াবার চালান জব্দ করা সম্ভব হচ্ছে। এর মধ্যে গত জুন মাসে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৫টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রণজিত কুমার বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখনো ইয়াবা আসছে সত্য, তবে আগের চেয়ে কমেছে।