গাড়ি ব্যবসায়ীকে স্বাস্থ্যের কাজ

  • ৩২ কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে ৯ কোটি টাকা আগাম নিয়েও যথাসময়ে পণ্য দেয়নি।

  • টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে কিছু সরবরাহ করে, যার একাংশ ব্যবহার অনুপযোগী।

করোনাকালে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিইর মতো জরুরি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রকল্প থেকে ৩২ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে নামসর্বস্ব অটোমোবাইল কোম্পানিকে (গাড়ি ব্যবসায়ী)। সাড়ে ৯ কোটি টাকা আগাম দেওয়ার পরও যথাসময়ে কোনো মালামাল দেয়নি। পরে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে কিছু মাস্ক ও গ্লাভস সরবরাহ করে তারা, যার মধ্যে ২৪ হাজার মাস্ক ব্যবহারের অনুপযোগী।

সরকারি তদন্তে উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পের এ বিপুল কেনাকাটায় সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) ও ক্রয় আইন (পিপিএ) লঙ্ঘন করা হয়েছে। কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা যাচাই ছাড়াই জাদিদ অটোমোবাইলসকে ৩২ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তার সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

জরুরি সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ বেশি দামে দেওয়া হয় নাম সর্বস্ব এক প্রতিষ্ঠানকে। পদে পদে অনিয়ম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথিপত্রে জাদিদ অটোমোবাইলসের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, এই প্রতিবেদক সেখানে গিয়ে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাননি।

করোনা মোকাবিলায় নেওয়া ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পে (ইআরপিপি) দুর্নীতির তদন্তে গঠিত কমিটি সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। চার সদস্যের কমিটির প্রধান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. সাইফুল্লাহ আজিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে ৯ কোটি টাকা অগ্রিম তুলে নেওয়া ও নির্ধারিত সময়ে মালামাল দিতে না পারার বিষয়ে তাঁরা তদন্ত করেছেন। তাঁরা তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য প্রতিবেদনে মতামতসহ উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, জাদিদ অটোমোবাইলস আগাম যে সাড়ে ৯ কোটি টাকা নিয়েছিল, তার মধ্যে কিছু মালামাল পরে সরবরাহ করেছে।

নিশ্চয়ই দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কাজ দেওয়া পর্যন্ত কারও কারও তদবির ছিল। অটোমোবাইল কোম্পানিকে জরুরি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ দেওয়ায় এটা পরিষ্কার।
মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, মহাসচিব, বিএমএ

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দরপত্র ছাড়া সরাসরি কেনাকাটার ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর-২০০৮) অনুযায়ী একাধিক অভিজ্ঞ কোম্পানিকে অফার লেটার (দর প্রস্তাব চেয়ে পত্র) দেওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সরাসরি একটি কোম্পানির কাছ থেকে দর প্রস্তাব গ্রহণ করে তার নামেই কার্যাদেশ প্রদান করে পিপিএ-২০০৬ ও পিপিআর-২০০৮ লঙ্ঘন করা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক একক দরদাতা হিসেবে জাদিদ অটোমোবাইলস কোম্পানিকে নির্বাচন করেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে কোম্পানিটির কোনো অভিজ্ঞতার সনদ বা প্রমাণপত্র যাচাই করেনি মূল্যায়ন কমিটি। এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল কেনার সুনির্দিষ্ট কারিগরি বিনির্দেশ প্রস্তুতের জন্য কারিগরি উপকমিটি গঠনেরও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পণ্যের মূল্যও বাজার থেকে বেশি ধরা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইআরপিপি ও জাদিদ অটোমোবাইলসের সম্পাদিত চুক্তিতে ৩০ শতাংশ টাকা চুক্তি সইয়ের ১৫ দিনের মধ্যে অগ্রিম দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বিশ্বব্যাংক ২১ জুলাই ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ছাড় করে। শর্ত ছিল অগ্রিম পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে পণ্য দেয়নি। যদিও প্রকল্পের আইটি কনসালট্যান্ট মির্জা মাসুদ সে সময় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে গুদামে মালামাল আছে। পরে এ বিষয়ে তিনি তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশেই তিনি তখন এমন কথা বলেছেন।

প্রশ্ন ওঠার পর কিছু মাল পাঠায়

তদন্ত কমিটির সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর গত ৫ আগস্ট বিশ্বব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটি বৈঠক হয়। সেখানে বলা হয়, এ প্রকল্পের মালামাল কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) পাঠানো হবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প পরিচালক গত ২৩ আগস্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জানান, সিএমএসডিতে দেড় লাখ কেএন-৯৫ মাস্ক, ১ লাখ গ্লাভস এবং ৫০ হাজার এন-৯৫ মাস্ক পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সিএমএসডি থেকে ২৫ আগস্ট কমিটিকে জানানো হয়, মাস্ক দুই হাজার কম দেওয়া হয়েছে। ২৪ হাজার মাস্ক ভেজা। এ ছাড়া কোনো পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) সরবরাহ করা হয়নি। এ কারণে সিএমএসডি মালামাল চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করেনি। পরে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই সরবরাহের জন্য ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় চায়।

তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, প্রকল্প পরিচালক (তৎকালীন) ইকবাল কবীর বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ না করে তথ্য গোপন করেছেন।

এ বিষয়ে ইকবাল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে যখন থেকে মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে অর্থাৎ জুনের ২২ তারিখের পর থেকে আমি কোনো মাস্ক বা পিপিই বা অন্য কোনো কিছু সরবরাহ করিনি।’

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে জাদিদ অটোমোবাইলসের ঠিকানা মিরপুরের পল্লবীর কে/৬ এক্সটেনশন। গত শনিবার ওই ঠিকানায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সেখানে একটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। নিচতলায় টেইলার্সসহ বিভিন্ন দোকান। ওপরে আবাসিক ফ্ল্যাট। ওই ভবনের তিনজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ২০-২২ বছর ধরে এখানে থাকেন। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান দেখেননি।

জাদিদ অটোমোবাইলসের মালিক কাজী শামীমুজ্জামান কাঞ্চনের বক্তব্য জানতে নথিপত্রে থাকা তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল করে এবং খুদে বার্তা (এসএমএস) ও ই-মেইল পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।

দায় প্রকল্প পরিচালকের

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার মতো জরুরি পরিস্থিতিতে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছিল অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে যার দায় প্রকল্প পরিচালকের।

শুরু থেকে এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও গবেষণা শাখার পরিচালক ইকবাল কবির। মালামাল কেনায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর গত ২২ জুন ইকবাল কবিরকে পদ থেকে সরিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।

অনভিজ্ঞ এবং অটোমোবাইল কোম্পানিকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার মালামাল সরবরাহের কাজ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইকবাল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এককভাবেই এই অটোমোবাইল কোম্পানিকে কাজ দিইনি। এ কাজ দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং তৎকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের অনুমোদন ছিল।’

এ বিষয়ে জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ বা কোন কাজ কাকে দেবে সে বিষয়ে মন্ত্রীর কোনো কিছুই জানার কথা নয়। সেটা মন্ত্রীর এখতিয়ারও নয়। মন্ত্রী বা সচিব অনুমোদন দেয় প্রকল্পের। কাজ কে কাজ পাবে তা ঠিক করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রকল্প পরিচালকই পুরো বিষয় দেখভাল করে, সরবরাহকারীকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ভূমিকাই বেশি।’

ইকবাল কবীর আগাম সাড়ে ৯ কোটি টাকা দেওয়ার বিষয়েও দায় এড়িয়ে প্রকারান্তরে বিশ্বব্যাংকের ওপর দায় চাপিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক সরাসরি এই প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করেছে, এখানে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। চুক্তি অনুযায়ী এ টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে।’

বিশ্বব্যাংক যা বলল

জরুরি এই প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই–মেইলে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। জবাবে সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ ও ভুটান) মার্সি টেমবন বলেন, গত মার্চে বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়, তখন করোনার চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর (পিপিই) বাজার অস্থির ছিল। ঘাটতিও ছিল ব্যাপক। ওই সময় সংকট মোকাবিলায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সীমিত পর্যায়ে কিছু জরুরি পণ্য কেনার উদ্যোগ নেয়। এ চুক্তিগুলো সুনির্দিষ্টভাবে পর্যালোচনা করা হবে। দেখা হবে যে যেভাবে কাজটি করার কথা ছিল, তা হয়েছে কি না এবং সার্বিক মান (কমপ্লায়েন্স) নিশ্চিত করা হয়েছে কি না। যখন বিশ্বব্যাংক প্রতারণা বা দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পায়, তখন তা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কাছে পাঠায়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অনিয়মে যুক্ত কোম্পানিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অন্য কোনো প্রকল্পে কাজ পাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জানান, করোনা মহামারিতে কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ১০ কোটি ডলারের (৮৫০ কোটি টাকা) জরুরি সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থায়নের প্রকল্পে প্রতারণা ও দুর্নীতির অভিযোগকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়।

আইনি ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বলেছে, কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনসেবা নিশ্চিত করতে জরুরি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ না করায় সরাসরি ক্রয়ের শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সংগ্রহে অভিজ্ঞ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন না করায় যথাসময়ে মামলাগুলো পাওয়া যায়নি। এ দায় প্রকল্প পরিচালকের ওপর বর্তায়। এ ছাড়া সরবরাহকারী নির্দিষ্ট সময়ে মালামাল সরবরাহ না করে সরকার তথা জনস্বার্থের অনেক ক্ষতি করেছে। কমিটি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ, সরকারি অর্থ আদায় ও পুরো প্রকল্পে অনিয়মের জন্য জড়িত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা অন্যায় করেছে তারা শাস্তি পাবে, বিভাগীয় মামলা হবে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন তো তদন্ত করছেই।’

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়, নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় অনিয়ম অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে জাদিদ অটোমোবাইলসের মালিক শামীমুজ্জামান কাঞ্চনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিশ্চয়ই দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কাজ দেওয়া পর্যন্ত কারও কারও তদবির ছিল। অটোমোবাইল কোম্পানিকে জরুরি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ দেওয়ায় এটা পরিষ্কার। এখানে যে অনিয়ম তা স্পষ্ট। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের উচিত অন্য প্রকল্পগুলোও খতিয়ে দেখা, সেখানে অনিয়ম হয়েছে কি না।