‘গ্রুপভিত্তিক সরকারবিরোধী কর্মসূচির’ অভিযোগে এখন তাঁরা কারাগারে  

দিয়াবাড়ি থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ভিয়েতনামফেরত ৮১ প্রবাসীকে নিয়ে যায় পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

প্রতারণার শিকার অভিবাসী শ্রমিকেরা দেশে ফেরার দাবি নিয়ে ভিয়েতনাম দূতাবাসের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন মধ্য জুলাইয়ে। শুরু থেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ, এই শ্রমিকেরা ভিয়েতনামে বাংলাদেশ দূতাবাস দখল করতে গেছেন। তাঁরা দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করেছেন। এরপর শ্রমিকেরা দেশে ফিরলে দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে উত্তরার দিয়াবাড়িতে রাখা হয়। কোয়ারেন্টিন শেষে এসব অভিযোগে তাঁদের কারাগারে পাঠায় পুলিশ।


আজ মঙ্গলবার সকালে উত্তরার দিয়াবাড়ির কোয়ারেন্টিন সেন্টার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ৮১ জন অভিবাসী শ্রমিককে আদালতে নিয়ে যায় তুরাগ থানার পুলিশ। ভিয়েতনাম থেকে ফেরা বাকি ২৫ জনকে অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট একটি বিশেষ বিমানে করে ১০৬ জন বাংলাদেশে পৌঁছান। তখন থেকে তাঁরা উত্তরার দিয়াবাড়িতে ছিলেন।

দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা ভিয়েতনামে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। যাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ওই দলটির সঙ্গে ছিলেন না।


তুরাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসমাউল হুসনা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ভিয়েতনামে নানা অপরাধে জড়িত ছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফেরত পাঠানোর সময়ই পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা ছিল। পুলিশ সেই মোতাবেক কাজ করেছে।


ভিয়েতনামফেরত ৮১ জন ও কাতারফেরত ২ জনের বিরুদ্ধে তুরাগ থানার পুলিশ ‘গ্রুপভিত্তিকভাবে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মসূচি পালন’সহ বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটাতে সলাপরামর্শ করার অভিযোগ এনেছে আদালতের কাছে। তুরাগ থানার উপপরিদর্শক মো. আনোয়ারুল ইসলাম আদালতের কাছে তাঁদের ‘সুষ্ঠু তদন্তের’ স্বার্থে জেলহাজতে আটক রাখা প্রয়োজন বলে আরজিতে উল্লেখ করেন।

আদালতের কাছে পুলিশ দাবি করেছে, ভিয়েতনামের ৮১ জন ও কাতারের ২ জন বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন। তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। কোয়ারেন্টিন সময়ের পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলে তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, পারিবারিক সহিংসতা ও জঙ্গি নাশকতামূলক অপরাধে সম্পৃক্ত হতে পারেন।

পুলিশ নিয়ে যাওয়ার আগে কথা হয় কোয়ারেন্টিনে থাকা ভিয়েতনামফেরত শ্রমিক মো. আলমগীর আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ৩০ আগস্ট পুলিশ তাঁদের আদালতে নেবে বলে জানায়। কেন নেওয়া হবে, এর কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। তাঁরা অবৈধ উপায়ে বিদেশে যাননি। প্রত্যেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র ছিল। দালালেরা তাঁকে বলেছিলেন, ভিয়েতনামে সোফা ফ্যাক্টরিতে কাজ দেবেন। কিন্তু সেই কাজ তিনি পাননি। ওখানে পৌঁছানোর পর ছোটখাটো দু-চারটে কাজ দিলেও কোনোটিই দীর্ঘমেয়াদি ছিল না। একপর্যায়ে তিনিসহ আরও অনেকে পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে পড়েন। তাঁরা আশা করছিলেন, প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও ভিয়েতনামে তাঁদের স্বজনেরা কোনো অন্যায় কাজে যুক্ত ছিলেন না এবং কখনো গ্রেপ্তার হননি বলে জানান। মো. সুমনের ভাই মুস্কুর আলী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই দুই বছর আগে কাজে গিয়েছিলেন। কখনো তিনি সে দেশের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হননি। মো. দেলওয়ার হোসেন নামের আরেকজন বলেন, তাঁর ভাই ৭-৮ মাস আগে ভিয়েতনামে যান। তাঁকে ৪০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল। ওখানে পৌঁছানোর পর তাঁর ভাই বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনিও কোনো অপরাধে লিপ্ত ছিলেন না।


এই শ্রমিকেরা ভিয়েতনামের ভুং তাও থেকে ১ হাজার ৬৭৭ কিলোমিটার দূরের হ্যানয়ে এসে ভিয়েতনামে বাংলাদেশি দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেন। তাঁরা ফেসবুক লাইভে এসে তাঁদের সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিয়েতনাম সরকার সে দেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ওই সময় সাংবাদিকদের বলেন, অভিবাসী শ্রমিকেরা বাংলাদেশ মিশন দখল করার চেষ্টা করছিলেন।

এমনকি দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে বিএমইটি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও চিঠি দেয়। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বলেন, ‘কর্মীরা প্রতিনিয়ত এনজিও, মানবাধিকারকর্মী এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’


মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ভিয়েতনামফেরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের আইনগত সহযোগিতা দেবে। আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এই শ্রমিকদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন।


এর আগে কুয়েত থেকে ১৪১, কাতার থেকে ৩৯ এবং বাহরাইন থেকে ৩৯ জনসহ মোট ২১৯ জন প্রবাসী দেশে ফেরার পর তাঁদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রবাসীদের সাজা মওকুফ করে দেশে পাঠিয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে পুলিশ একই আরজি জানিয়েছিল।