চট্টগ্রাম নগরের গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় রাতের আঁধারে একটি শিবমন্দিরের দুটি মূর্তি ভেঙেছে দুর্বৃত্তরা। মূর্তির ভাঙা অংশ জড়ো করে মন্দির চত্বরেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। এ ছাড়া মন্দিরের সীমানাদেয়ালে খোদাই করা সনাতন ধর্মের দেবী ও কয়েকজন গুরুর ছবিতে কালো টেপ লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। গত শনিবার রাত ১০টার পর থেকে গতকাল রোববার সকাল ৬টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
এদিকে মন্দিরের মূর্তি ভাঙার দায় স্বীকার করে নাটকীয়ভাবে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছেন এক ব্যক্তি। তাঁর নাম মো. শুক্কুর (৪০)। তিনি আগ্রাবাদের দাইয়াপাড়া এলাকায় থাকেন বলে পুলিশকে বলেছেন। গতকাল বিকেল চারটার দিকে একটি ত্রিশূল নিয়ে তিনি ওই মন্দিরে আসেন। ভেঙে ফেলা একটি মূর্তির সঙ্গে ছিল এই ত্রিশূল।
চট্টগ্রাম নগরের বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিকাশ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিনিসহ পুলিশের কয়েকজন সদস্য গতকাল বিকেলে মন্দিরের পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। চারটার দিকে এক লোক ত্রিশূল হাতে এসে বলতে থাকেন, ‘আমি মাফ চাই। এসব আমি ভেঙেছি।’ তখন তাঁকে গ্রেপ্তার করেন তাঁরা। মন্দিরের পূজার্থীরা তখন জানান, ত্রিশূলটি মূর্তির সঙ্গে ছিল। গ্রেপ্তার হওয়া শুক্কুর বলেছেন, মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনায় তিনি অনুতপ্ত। তাই ত্রিশূল নিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করতে মন্দিরে এসেছেন।
পুলিশের কয়েকজন সদস্য বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শুক্কুরকে নেশাগ্রস্ত বলে মনে হয়েছে। তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বন্দর থানায় পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গতকাল সকালে গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় মূর্তি ভাঙচুরের খবর জানাজানি হওয়ার পর ক্ষোভ প্রকাশ করেন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ। সকাল ৯টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত নগরের আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কের গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। নগরের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস কার্যালয় ও বিমানবন্দরে যেতে হয়। অবরোধের কারণে সড়কের দুই দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
গোসাইলডাঙ্গার মন্দিরটির নাম ‘শিবালয়’। একতলা এই মন্দিরের তিন পাশে বাড়ি ও দোকান রয়েছে। আরেক পাশ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। ২০০৫ সালে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তির উদ্যোগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠাতাদের একজন অজিত শীল। তিনি বলেন, শনিবার রাত ১০টায় মন্দিরের মূল ভবনে তালা লাগিয়ে চলে যান তিনি। গতকাল সকাল ৬টায় এসে দেখেন মন্দির চত্বরে থাকা দুটি মূর্তি ভাঙা। মূর্তির ভাঙা কিছু অংশ এবং মেঝের কার্পেট জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে প্রতিবেশী ও পুলিশকে ঘটনাটি জানান তিনি।
মন্দিরে হামলার আগে কারও কাছ থেকে কোনো হুমকি পেয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে অজিত শীল বলেন, আগে কেউ হুমকি দেয়নি। কারও সঙ্গে তাদের বিরোধও নেই।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মন্দির চত্বরে থাকা মাটি ও সিমেন্টের তৈরি কাল ভৈরবী মূর্তিটি ভাঙা। এর পাশে নন্দীকেশর (শিবের বাহন) নামে সিমেন্টের তৈরি আরেকটি মূর্তির মাথা ও শিং পড়ে আছে। মন্দিরের মূল কক্ষের তালায়ও ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার চিহ্ন রয়েছে। মন্দির চত্বরের মধ্যে আগুন দেওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে তখনো ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
মন্দিরের পাশের বাড়ির বাসিন্দারা বলেন, রাতের এই ঘটনা তাঁরা কেউ টের পাননি। মন্দিরের বাইরে বা ভেতরে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই।
শিবমন্দিরের পুরোহিত রণজিৎ চক্রবর্তী বলেন, মন্দিরের পাশে বহুতল ভবনের নির্মাণ চলছে। রাতেও কাজ চলে। নির্মাণকাজের শব্দের কারণে মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনাটি কেউ হয়তো আঁচ করতে পারেননি।
এই মন্দিরের ২০০ গজের মধ্যে আরও দুটি মন্দির রয়েছে। তবে সেগুলো অক্ষত আছে।
মন্দিরে হামলার বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আরেফিন জুয়েল বলেন, কখন কীভাবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। মন্দিরের মূল ফটকের তালাও লাগানো রয়েছে। কোন দিক দিয়ে, কীভাবে দুর্বৃত্তরা ঢুকেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ জন্য আশপাশের ভবন ও সড়কের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, এলাকার এক প্রহরী শনিবার রাত তিনটার দিকে এক লোককে মন্দির এলাকায় ঢুকতে দেখেছেন। ওই ব্যক্তিই বিকেলে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন কি না, সিটি গতকাল রাত নয়টা পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।