চাকরির আড়ালে ‘ডাকাত চক্র’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সহকারী পরিচালক এস এম সাকিব হোসেন আট সদস্যের চক্র গড়ে তুলেছিলেন।

■ অধিদপ্তরের গঠিত কমিটিও অভিযোগের ‘সন্দেহাতীত প্রমাণ’ পেয়েছে।

■ সাকিবের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার বিচারকাজ চলছে।

সাকিব হোসেন

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এস এম সাকিব হোসেন চাকরির আড়ালে একটি ডাকাত চক্র গড়ে তুলেছিলেন। এ চক্রের সদস্য ৮। গত বছরের জানুয়ারিতে পুরান ঢাকায় স্বর্ণালংকার ডাকাতির ঘটনায় ধরা পড়ার আগেও চক্রের সদস্যরা একই কাজ করেছেন।

সাকিবের তিন সহযোগী ইব্রাহিম শিকদার, জীবন পাল ও রতন কুমার সেন আদালতে এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। পুলিশের তদন্তেও একই তথ্য উঠে এসেছে।

গত বছরের ৭ জানুয়ারি পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার পার্কের সামনে মুন্সিগঞ্জের ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমানের ৯০ ভরি স্বর্ণালংকার ও প্রায় ৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় সাকিব নিজেকে ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। এ ঘটনায় করা মামলায় সাকিবসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অন্য আসামিরা হলেন অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এমদাদুল হক, সিপাহি আমিনুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন এবং গাড়িচালক ইব্রাহীম শিকদার। এ ছাড়া সাকিবের তথ্যদাতা (সোর্স) হারুন মুনশি এবং দুই সহযোগী পুরান ঢাকার সোনা ব্যবসায়ী জীবন পাল ও সেখানকার একটি সোনার দোকানের কর্মচারী রতন কুমার সেনের বিরুদ্ধেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। সিপাহি আলমগীর ও জীবন পাল কারাগারে রয়েছেন। সাকিবসহ বাকি ছয়জন জামিনে আছেন।

পুরান ঢাকায় স্বর্ণালংকার ডাকাতির ঘটনায় গত বছরের ১২ জানুয়ারি কোতোয়ালি থানায় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান মামলা করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুবেল মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সাকিবের ডাকাত চক্রকে শনাক্ত করা হয়। পুরান ঢাকায় সোনা ডাকাতির আগে ২০২০ সালে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে এক ব্যবসায়ীর ২৩০ ভরি সোনা ডাকাতি করেছিলেন তাঁরা। ইব্রাহিম শিকদার, জীবন পাল ও রতন কুমার সেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গত বছরের ৭ জানুয়ারি পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার পার্কের সামনে মুন্সিগঞ্জের ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমানের ৯০ ভরি স্বর্ণালংকার ও প্রায় ৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় সাকিব নিজেকে ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসামিরা আদালতকে বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে সাকিবের নেতৃত্বে জীবন পাল, হারুন মুনশি, রতন কুমার এক ব্যবসায়ীর সোনা ডাকাতি করেন। এতে জীবন দেড় লাখ টাকা, রতন ও হারুন ৬ লাখ টাকা করে ভাগ পান।

করতেন চাঁদাবাজি

মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের ব্যবসায়ী মো. বাবু ব্যাপারী থানায় অভিযোগ করেন, ২০২০ সালের ১৪ জুলাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক সাকিবসহ ১০-১২ জন তাঁর কাছে মাদক আছে বলে দাবি করেন। তল্লাশি করে কিছু না পেয়ে তাঁকে মারধর করেন। মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে ২ লাখ টাকা চাঁদা চান। দেড় লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি।

লৌহজং থানার তৎকালীন ওসি আলমগীর হোসেন এখন একই জেলার পদ্মা সেতু উত্তর থানায় কর্মরত। গত শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাকিবের চাঁদাবাজির বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছিল। তবে তখন কোনো মামলা হয়নি। সাকিবের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেতেন বলে জানান তিনি।

দেখাতেন দাপট, ফেসবুকে ‘ভুয়া পরিচয়’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাকিব নবীন কর্মকর্তা হলেও দাপটের সঙ্গে চলতেন। ফেসবুকে নাম লিখতেন ‘সাকিব শিকদার’। নিজেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিতেন। অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযানের ছবি পোস্ট দিতেন। ছাত্রলীগের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতেন। সিপাহি আমিনুলও কাউকে পাত্তা দিতেন না।

আদালত সূত্র জানায়, সাকিব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রুবেল মল্লিকসহ দুজনের বিরুদ্ধে সিএমএম আদালতে নালিশি মামলা করেন। এতে চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগ আনা হয়। আদালত তদন্ত করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. নাছিরউদ্দিন বলেন, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। সাকিব মামলার দায় থেকে বাঁচতে হয়তো তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিভাগীয় মামলা দায়ের

গত ২০ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাকিবসহ পাঁচ কর্মীর বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে অধিদপ্তর। কমিটি অভিযোগের ‘সন্দেহাতীত প্রমাণ’ পেয়েছে।

অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, সাকিবকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার বিচারকাজ চলছে।