ছিনতাইকারীদের হাতে ২১৬ চালক খুন

রাজধানীর চারপাশের জেলাগুলোতে ছিনতাই ও খুনের ঘটনা বেশি ঘটছে। ইজিবাইকের ব্যাটারি বিক্রি হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মুগদা ও বংশালে।

পিবিআইয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য

দেশে ছিনতাইকারীদের হাতে গত সাত বছরে ২১৬ জন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালক খুন হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে গত আট মাসে খুন হয়েছেন ৬৪ জন। খুনের শিকার অধিকাংশ চালকই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। এঁদের অনেকেই ঋণ নিয়ে অটোরিকশা ও ইজিবাইক কিনেছিলেন। স্বজন হারানোর শোকের সঙ্গে এখন ঋণের বোঝাও বইতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের।

সূত্রহীন মামলা তদন্তের অংশ হিসেবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সারা দেশে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালক খুনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাতে ২০১৫ থেকে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২১৬ জন চালক খুনের তথ্য উঠে আসে। পিবিআই সারা দেশে অটোরিকশাচালক হত্যা, এর কারণ, খুনের সঙ্গে জড়িত চক্র এবং প্রতিকারের উপায় নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির অংশ হিসেবে এই তথ্য সংগ্রহ করে।

সর্বশেষ, নিখোঁজের তিন দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের কালাইনগর গ্রামের তিতাস নদ থেকে কিশোর অটোরিকশাচালক কাজী মারুফের (১৩) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজু আহম্মেদ প্রথম আলোকে জানান, অটোরিকশা ছিনতাইয়ের জন্যই মারুফকে খুন করা হয়েছে বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। অভিযুক্তদেরও তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। এখন গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সর্বোচ্চ চারটি ব্যাটারি দিয়ে চলা গাড়িগুলোকে অটোরিকশা বলা হচ্ছে। আর পাঁচটি ব্যাটারি দিয়ে চালিত বড় অটোরিকশা সারা দেশে ইজিবাইক নামে পরিচিত। এসব ব্যাটারি সহজে বিক্রি করা যায় বলে আটোরিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট। এ ছাড়া তারা পুরো গাড়ি বা যন্ত্রাংশ আলাদা করেও বিক্রি করে দেয়। সারা দেশে এদের নেটওয়ার্ক আছে বলে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার ছিনতাইকারীরা জানিয়েছে।

সংসারের অভাব মেটাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এনজিও থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি অটোরিকশা কেনেন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের তরুণ হাকিম মিয়া। অটোরিকশা কেনার এক সপ্তাহ পরই সে নিখোঁজ হয়। ১৩ দিন পর (১ অক্টোবর ২০২০) হাওর থেকে তার গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরনে লুঙ্গি দেখে তাঁর বাবা মনির হোসেন ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। অটোরিকশাটি পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনার আড়াই মাস পর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে সুজন মিয়া নামের আরও এক চালককে খুন করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। চার মাস আগে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে অটোরিকশাটি কিনেছিলেন সুজন।

এই দুটি খুনের ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনের পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে কিশোরগঞ্জ জেলা পিবিআই। আসামিদের গ্রেপ্তার করায় হাকিম ও সুজনের পরিবার স্বস্তি প্রকাশ করেছে। তবে উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যুর পাশাপাশি ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে তাদের। হাকিমের বাবা মনির হোসেন বলেন, ‘ঋণ পরিশোধ কীভাবে করব বুঝতে পারছি না। আমাদের এখন দিশেহারা অবস্থা।’

পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, অটোরিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইকারীদের হাতে সবচেয়ে বেশি ৯৩টি খুনের ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। ঢাকার কাছের বিভিন্ন উপজেলা এবং কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জ এলাকায় খুনের ঘটনা বেশি। যোগাযোগ সুবিধার কারণে এসব এলাকা থেকে অটোরিকশাগুলো দ্রুত বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দিতে পারে ছিনতাইকারীরা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইজিবাইকে পাঁচটি ব্যাটারি থাকে। ছিনতাইকারীরা শুরুতেই ব্যাটারি বিক্রি করে দেয়। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মুগদা ও বংশালে পুরোনো ব্যাটারির দোকানে ইজিবাইকের ব্যাটারি বিক্রি করে তারা। অসাধু ব্যবসায়ীরা সব জেনেই কম দামে এসব ব্যাটারি কিনছেন।

সারা দেশে অটোরিকশা ছিনতাই ও খুনের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলোকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে অর্গানাইজড ক্রাইম নামের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি বিশেষায়িত ইউনিট আছে। এই বিভাগের দায়িত্বে থাকা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুল্লাহ হেল বাকী প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি চোর বা ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে তাঁরা বিশেষ নজর দিচ্ছেন। কিন্তু অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ঘটনাও যেন বাড়ছে।

অটোরিকশাচালক খুনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে মনে করে পিবিআই। খুনের ঘটনা বাড়ার কারণ জানতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত নিয়েছে সংস্থাটি। কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ ঘটনায় সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র জড়িত। অনেক পেশাদার চোর, ডাকাত পেশা পরিবর্তন করে অটোরিকশা চালাচ্ছে। কিন্তু তাদের কারও কারও অপরাধী মনোভাব পরিবর্তন না হওয়ায় সুযোগ পেলেই ছিনতাইয়ে জড়ায়। আবার ছিনতাইকারীদের চিনে ফেলায় চালকদের খুনের ঘটনা ঘটে। কখনো কখনো ছিনতাইয়ে বাধা দিলেও খুনের শিকার হতে হয়। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন না থাকায় সহজে অটোরিকশা ছিনতাই ও বিক্রি করা যায়।

গত দুই বছরে পাঁচটি খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে কিশোরগঞ্জ জেলা পিবিআই। কিশোরগঞ্জ জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি ঘটনার প্রতিটিই ছিল সূত্রবিহীন। প্রতিটি ঘটনাতেই সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত ছিল। অটোরিকশা ছিনতাই করতেই চালককে খুন করে তারা। ছিনতাইয়ের পর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আলাদা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এমন কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করেছেন তাঁরা।

সারা দেশের সূত্রহীন ৮৩ মামলার তদন্তভার পেয়েছে পিবিআই। এগুলোর মধ্যে ৩৬টি মামলার তদন্ত শেষ করেছে সংস্থাটি। ২৫টি খুনের ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে তারা। ১১টি খুনের ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি। এখনো ৪৭টি মামলার তদন্ত চলছে।

অনেক খুনের রহস্য অজানা

এক বছর আগে ফরিদপুরের নগরকান্দায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরহাদ খানকে খুন করে তাঁর অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এই ঘটনার কোনো সুরাহা করতে না পেরে তিন মাস আগে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ফরিদপুর জেলা পিবিআই। ফরিদপুর জেলা পিবিআই আরও দুটি হত্যা মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে না পেরে প্রায় তিন মাস আগে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর জেলার তিনটি, টাঙ্গাইলের দুটি, ঢাকা, রংপুর ও গাইবান্ধার একটি করে মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে না পেরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

ফরহাদ খান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রাম প্রসাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তের ওপর আমরা জোর দিয়ে থাকি। ঘটনাটি ঘটেছে মহাসড়কের পাশে। এখানে প্রতি ঘণ্টায় হাজার হাজার যাত্রী চলাফেরা করেন। কিন্তু ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। তাই খুনি শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব।’

জানতে চাইলে পিবিআইয়ের প্রধান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, চোরাই অটোরিকশার বাজার অনেক বিস্তৃত। এটা মুহূর্তের মধ্যেই বিক্রি করা যায়। তাই চুরি বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আসা মামলাগুলোর সুরাহা করে অপরাধীকে ধরতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে। কিন্তু চেষ্টা করেও রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে না পারলে তদন্ত কার্যক্রম গুটিয়ে আনা হয়। কারণ, এই মামলা অন্য সংস্থার কাছে গেলে তারাও অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে দেখতে পারবে।

ইজিবাইকের ব্যাটারি

যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে চুরি ও ছিনতাই করার ইজিবাইকের ব্যাটারি বিক্রি হওয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। একটি বড় ইজিবাইকে চার–পাঁচটি ব্যাটারি থাকে। পাঁচটি ব্যাটারির পাইকারি দাম ৬০ হাজার টাকা। দয়াগঞ্জে এসব ব্যাটারি বিক্রি হয় অর্ধেক দামে। আর ছোট অটোরিকশার চারটি নতুন ব্যাটারির দাম ২৪ হাজার টাকা। দয়াগঞ্জের ব্যবসায়ীরা তা কেনেন ১০ হাজার টাকায়। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১০ থেকে ১৫ জন ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা চোরাই ব্যাটারি কেনেন। এঁদের কাছ থেকে এই পুরোনো ব্যাটারিগুলো কিনে নেয় অটোরিকশা তৈরির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দয়াগঞ্জের ব্যাটারি ক্রয়ের সঙ্গে যুক্তদের বিষয়ে নজরদারি করা হয়। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুরোনো ব্যাটারি ক্রয়ের সময় বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি এবং মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ করার জন্য।

প্রতিকারের উপায় জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে পদ্ধতিগত কৌশল নির্ধারণে পিছিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে এবং কোন কোন এলাকায় বেশি ঘটছে—বিষয়গুলো সম্পর্কে সমন্বিত তথ্য সংগ্রহ করে নজরদারি বাড়ানো গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।