জাকিয়া সুলতানাকে তাহলে গ্রেপ্তার করল কে, দোষটা কী

রাজধানীর মিরপুরের নবাবেরবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার এ বাড়ি নিয়ে বিরোধের জেরে মো. মাহমুদুল হাসান ও তাঁর ভাবি জাকিয়া সুলতানা গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে স্বজনদের অভিযোগ
ছবি: সংগৃহীত

অভিযোগ ছিল জাকিয়া সুলতানার (৫৩) দেবর মো. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব-৪ তাঁকে গ্রেপ্তার করে পরদিন শাহ আলী থানায় সোপর্দ করে। জাকিয়া থানায় গেলে তাঁকেও মাদক মামলায় আসামি দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাব বা পুলিশ কেউই এখন আর জাকিয়াকে গ্রেপ্তারের দায় নিতে চাইছে না।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, যে বাসা থেকে মাহমুদুল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়, সে বাসার মালিকানা দেবর-ভাবি দুজনেরই। তবে র‌্যাব জাকিয়া সুলতানাকে গ্রেপ্তার করেনি। র‌্যাব মামলা করেছে। এখন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জাকিয়ার সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখবেন। অন্যদিকে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, র‌্যাব সদস্যরা আসামি ধরে তাঁদের হাতে দিয়ে গেছেন।

জাকিয়া সুলতানা এক দিনের কারাবাস শেষে বৃহস্পতিবার মুক্তি পেয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। মিরপুর চিড়িয়াখানার পেছনের নবাবেরবাগ বেড়িবাঁধ এলাকায় তাঁদের একটি নয়তলা ভবন আছে। ওই ভবন নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে মামলা চলছে। ওই ঘটনায় তাঁদের প্রতিপক্ষ র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। র‌্যাবের করা মামলায় তাঁর নাম ছিল।

কী ঘটেছিল, জানতে চাইলে জাকিয়া সুলতানা বলেন, তিনি ধানমন্ডিতে এবং তাঁর দেবর লালমাটিয়ায় থাকেন। ঘটনার দিন নবাবেরবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার ভবন থেকে ভাড়া তুলে দেবর মাহমুদুল হাসান লালমাটিয়ার বাসায় ফিরছিলেন। রাত ১০টা কি সাড়ে ১০টার দিকে র‌্যাব তাঁকে আটকায়। পরে সেখান থেকে মাহমুদুলকে নিয়ে তাঁদের ভবনে যায়। তিনি শুনেছেন, ভবনে ঢুকেই র‌্যাব সদস্যরা সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে নিয়েছিলেন। ভবনের যে তত্ত্বাবধায়ক, তাঁর নাম কামাল। তাঁরা ‘কামাল, কামাল’ বলেও চিৎকার করছিলেন। র‌্যাব সদস্যদের দেখে কামাল পালিয়ে যান।

জাকিয়া সুলতানা বলেন, দু-একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে তাঁরা খবর দিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলে তাঁরা যাওয়ার পর র‌্যাব সদস্যদের কেউ কেউ জ্যাকেট খুলে ফেলেন। তবে প্রথম আলো এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।

জাকিয়া সুলতানা জানান, তিনি বাসা থেকে খোঁজখবর রাখছিলেন, তাঁর আরেক দেবরকেও ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি আগেই মারা গেছেন। স্বামী ওসমান গণি মারা গেছেন গত বছর। তিনিই এখন পরিবারের অভিভাবক।

পরদিন পরিবার জানতে পারে, মাহমুদুল হাসানকে র‌্যাব-৪–এর কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। রাত আটটায় তাঁকে থানায় সোপর্দ করা হবে। দেবরের লালমাটিয়ার বাসায় ইফতার সেরে তিনি তাঁর জাকে নিয়ে থানায় যান। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত র‌্যাবের গাড়ি ও র‌্যাব সদস্যদের আনাগোনা ছিল। তাঁরা বারবার মাহমুদুলের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন। একটা সময় পুলিশ তাঁদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়।

বেরিয়ে আসার সময় পুলিশ সদস্যরা জাকিয়া সুলতানাকে বলেন, তিনি বের হতে পারবেন না। মামলায় তাঁর নাম আছে। এমন মামলা যে এক বছর তাঁকে কারাগারে থাকতে হবে। জাকিয়ার ভাষ্যমতে, পুলিশই তাঁকে জানিয়েছিল, বাড়িটার দখল নিতে তাদের প্রতিপক্ষ র‌্যাবের সহযোগিতা নিয়েছে। জাকিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ পরে আদালতে পাঠায়। সেখান থেকে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

জাকিয়া সুলতানার ভাষ্যের সঙ্গে মামলার এজাহারের বক্তব্যের কিছু অমিল পাওয়া যায়। র‌্যাবের উপসহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন এজাহারে লিখেছেন, রাত সোয়া তিনটার দিকে দিয়াবাড়ি মোড়ের ল্যান্ডিং স্ট্যান্ডের উল্টো দিকে গৃহনির্মাণ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড বিল্ডিংয়ের সামনে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মাহমুদুল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি গাড়িতে বসে থাকা অবস্থাতেই র‌্যাব তাঁকে তল্লাশি করে এবং তিনি নিজেই তাঁর কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র বের করে দেন।

তথ্যের ভিত্তিতে মাহমুদুল হাসানকে নিয়ে নবাবেরবাগ বেড়িবাঁধে অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় তাঁর জিম্মা থেকে ১০৫টি ইয়াবা, হরিণের চামড়া ও জাল টাকা পাওয়া যায়। তাঁর বিরুদ্ধে র‌্যাব আলাদাভাবে চারটি মামলা করে। এর মধ্যে জাকিয়াকে মাদক মামলায় আসামি করা হয়।

জাকিয়ার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী, জানতে চাইলে র‌্যাব-৪–এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, এসব বিষয়ে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কথা বলবেন।

খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, যে বাসায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেই বাসার মালিকানা দেবর-ভাবির। সে কারণে জাকিয়া সুলতানাকে আসামি করা হয়।

এখন তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে দেখবেন জাকিয়ার সম্পৃক্ততা কতটুকু। আদালত তাঁকে জামিন দিয়েছেন। তবে অভিযানে কোনো ভুল নেই। মাহমুদুল হাসান এর আগেও কাফরুল থেকে একে-৪৭ অস্ত্রসহ ধরা পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক মামলাও রয়েছে। আর র‌্যাব–৪–এর কোম্পানি কমান্ডার জয়িতা শিল্পী বলেছেন, যে গাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, সে গাড়ি জাকিয়া সুলতানার নামে। তিনি দেবরকে সহযোগিতা করতেন। গাড়িও ব্যবহার করতেন।

জাকিয়া সুলতানার স্বজনদের অভিযোগ, এ ঘটনায় র‌্যাব কর্মকর্তা জয়িতা শিল্পী ও তাঁর স্বামী মহানগর যুবলীগের (উত্তর) দপ্তর সম্পাদক কামরুজ্জামানের সম্পৃক্ততা আছে। তবে জয়িতা বলেছেন, অবৈধ অস্ত্র থাকার পাকা খবর নিয়েই তাঁরা অভিযান চালান। অভিযানের সঙ্গে স্বামীর যোগাযোগ নেই।

জয়িতা শিল্পীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে খন্দকার আল মঈন বলেছেন, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে যে কেউ লিখিতভাবে অভিযোগ জানাতে পারেন।
শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, বাড়ি নিয়ে ওখানে একটা ঝামেলা আছে। তবে সে কারণে কিছু হয়েছে বলে তিনি জানেন না। আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনেছে র‌্যাব।