‘টাকা নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও’

পুলিশ প্রথমে বলেছিল, রায়হান গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন। তাঁকে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। পরে পুলিশের উল্লেখ করা গণপিটুনি স্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এমন কোনো দৃশ্য পাওয়া যায়নি। পরিবারের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।

রায়হান উদ্দিন আহমদ
ছবি: সংগৃহীত

সিলেট কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে মৃত্যুর আগে তাঁকে বাঁচাতে পরিবারের সদস্যদের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন মো. রায়হান আহমদ (৩৪)। তিনি বলেছিলেন, পুলিশের দাবি করা ১০ হাজার টাকা নিয়ে দ্রুত ফাঁড়িতে যেতে। মামলার এজাহারে নিহত রায়হানের স্ত্রী এমন কথাই উল্লেখ করেছেন।

রায়হানের স্ত্রী এজাহারে উল্লেখ করেন, শনিবার বিকেল তিনটার দিকে রায়হান নিজের কর্মস্থল নগরীর রিকাবিবাজার এলাকার স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রে যান। পরের দিন রোববার ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটে একটি মোবাইল ফোন নাম্বার থেকে রায়হানের মা সালমা বেগমের মোবাইল ফোনে কল আসে। ফোন কলটি ধরেন রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ। এ সময় রায়হান ‘টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও’ বলে আকুতি জানান। এ কথা শুনে চাচা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। রায়হান কোথায় জানতে চাইলে একজন পুলিশ বলেন, তিনি (রায়হান) ঘুমিয়ে গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসার কথা জানালে ওই পুলিশ সদস্য তাঁকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসতে বলেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, পুলিশের কথা মতো রায়হানের চাচা সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। দায়িত্বরত পুলিশ তখন জানান যে রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চাচা তখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তিনি সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যান।

এই ঘটনায় রোববার রাত আড়াইটার দিকে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় তিনি কাউকে আসামি করেননি। তবে মামলার এজাহারে যে মুঠোফোন থেকে পরিবারের কাছে কল এসেছিল, তার নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। 'টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও'—রায়হানের এই আকুতি তুলে ধরা হয়।

হাতে লেখা এজাহারের কপিতে সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) সৌমেন মৈত্রের সিলযুক্ত স্বাক্ষর আছে। যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এজাহারের বর্ণনাসহ সব বিষয়ে তদন্ত চলছে।

আরও পড়ুন

পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তাহমিনা এজাহারে উল্লেখ করেন, 'আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।'

রায়হানের বাসা সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নিহারিপাড়ায়। পরিবারে তাঁর স্ত্রী, দুই মাস বয়সী এক মেয়ে, মা ও চাচারা আছেন। রোববার মধ্যরাতে এজাহার দাখিলের সময় তাহমিনার সঙ্গে রায়হানের মা, চাচাসহ পরিবারের সদস্যরা ছিলেন।

রায়হানের পরিবারের ভাষ্য, রায়হান রিকাবিবাজার এলাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করতেন। গত শনিবার রাতে বাসায় না ফেরায় তাঁকে খোঁজাখুঁজি করেন পরিবারের সদস্যরা। রোববার ভোরে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কাছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে ফোনে জানানো হয়, রায়হান পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। পরে জানতে পারেন, রায়হান মারা গেছেন। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে রায়হানের পরিবারকে জানানো হয়, নগরীর কাস্টঘর এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ধরা পড়ে গণপিটুনিতে রায়হান আহত হন। পরে তিনি মারা যান।
তবে রায়হানের পরিবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, কাস্টঘর এলাকায় কোনো ছিনতাই বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। তখন পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর অভিযোগ তোলা হয়। ওই এলাকার সিসি ক্যামেরাতেও গণপিটুনির কোনো চিত্র পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সোমবার বিকেলে ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন