‘টোপ পার্টি’র আস্তানা এখন দ্বারিয়াপুরে

গড়াই নদঘেঁষা এই এলাকার কয়েক শ যুবক জড়িয়ে পড়েছেন প্রতারণায়, যা ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্য এলাকাতেও।

  • চক্রের বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৬ থেকে ৩৫ বছর। অধিকাংশ মাদকাসক্ত।

  • তিন জেলার সীমান্ত হওয়ায় পুলিশের নজরদারিও কম।

প্রতারণা করতে মুঠোফোন নম্বর ক্লোন করে সংঘবদ্ধ চক্রপ্রতীকী ছবি

‘হ্যালো, বিকাশ থেকে নাহিদ বলছি...।’ এরপর আলাপে আলাপে পিন নম্বর কিংবা নিরাপত্তা কোড সংগ্রহ করে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের (এমএফএস) গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। ডিজিটাল এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা নানা কৌশলে মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রতারক চক্রগুলোকে স্থানীয় লোকজন নাম দিয়েছেন ‘টোপ পার্টি’। কিছুদিন আগেও শ্রীপুরের পার্শ্ববর্তী ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ও রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির কিছু এলাকায় এ চক্রের সদস্যদের বসবাস ছিল সবচেয়ে বেশি। এখন যার বিস্তার ঘটেছে দ্বারিয়াপুরে। তিন জেলার সীমান্তে গড়াই নদঘেঁষা এই এলাকার কয়েক শ যুবক জড়িয়ে পড়েছেন প্রতারণার সঙ্গে, যা ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশের এলাকাতেও।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুঠোফোনে প্রতারণা করা এই চক্র দ্বারিয়াপুর ইউনিয়নের মহেশপুর, চর মহেশপুর, গোয়ালদহ, চর গোয়ালদহ, চৌগাছী, চর চৌগাছি, ঘষিয়াল, দ্বারিয়াপুর ও শ্রীকোল ইউনিয়নের বরিশাটসহ বেশ কিছু গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে সদর উপজেলার আঠারোখাদা, গাংনালীয়া ও কছুন্দী গ্রামেও প্রতারক চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছেন।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, কেবল মহেশপুর ও চর মহেশপুর গ্রামেই প্রতারণায় জড়িত ১২০ জনের তালিকা পুলিশের হাতে রয়েছে। বরিশাট গ্রামে দুটি গ্রুপে রয়েছে প্রায় অর্ধশত যুবক। অন্য গ্রামগুলোতে আরও শতাধিক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

বরিশাট গ্রামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের কিছুদিন আগেও কিছু (সম্পদ) ছিল না, তারা দেখি দালান ওঠাচ্ছে, তাদের ছেলেরা দামি দামি মোটরসাইকেলে ঘোরে। কারও কাছে শুনলে বলে টোপের ব্যবসা করে। শুনেছি পুলিশ জেনেও তাদের কিছু বলে না।’

স্থানীয় লোকজন বলছেন, এসব চক্র মূলত বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়। চক্রের একটি দল কৌশলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের লেনদেনের খাতার ছবি সংগ্রহ করে। আরেক দল দোকানি পরিচয়ে ফোন দিয়ে ভুলে টাকা চলে গেছে বলে গ্রাহকের টাকা ফেরত চান। গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার কথা বলে পিন নম্বর সংগ্রহ করে ফাঁদ পেতেও টাকা আদায় করে থাকে। পাশাপাশি সিম ক্লোনসহ নানা কৌশল অবলম্বন করেন তাঁরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, টাকা তোলার ক্ষেত্রে ভুয়া পরিচয়ে খোলা অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়।

মহেশপুর গ্রামের এক ডজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের দিকে গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি প্রথমে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। পরে গ্রামের উঠতি যুবকেরা যুক্ত হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার সবাই সব জানে, কিন্তু কেউই মুখ খুলতে সাহস পায় না। কারণ, এরা বড় গ্যাংয়ের মতো হয়ে গেছে।’

স্থানীয় লোকজন বলছেন, চক্রের বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৬ থেকে ৩৫ বছর। তাঁদের বেশির ভাগ মাদকাসক্ত। তাঁরা ৮ থেকে ১০ জনের দল হয়ে কাজ করেন। চরাঞ্চল বা নদীপাড়ের নির্জন জায়গায় বসে দল বেঁধে মাদকসেবন ও প্রতারণা করার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, এখানকার প্রতারকেরা দেশের অন্য প্রান্তের মানুষকে ফাঁদে ফেলেন, যে কারণে স্থানীয় থানায় অভিযোগ আসে কম। এলাকাগুলো তিন জেলার সীমান্ত হওয়ায় পুলিশের নজরদারিও কম।

শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রিটন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি থানায় নতুন যোগদান করেছেন। এ ধরনের প্রতারক চক্রের তথ্য পেয়েছেন। নতুন দল করে কাজের পরিকল্পনা করছেন। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা পেলে এটা নির্মূল করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।