নার্সিংয়ের লতিফের অনিয়মের শেষ নেই

এক ব্যক্তি একই সঙ্গে একাধিক পদে সংযুক্তিতে আছেন। একাধিক বাসন–সুবিধাও নিচ্ছেন।

ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজ
ছবি: ফেসবুক

সরকারের ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক মো. আব্দুল লতিফের অনিয়মের শেষ নেই। মূল কর্মস্থল ময়মনসিংহে হলেও একই সঙ্গে ঢাকায় তিনি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরসহ দুটি প্রতিষ্ঠানে সংযুক্তিতে আছেন।

বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে আব্দুল লতিফ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের নানা ধরনের মডিউল বা নির্দেশনা তৈরি করেন। তিনি প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী, প্রশিক্ষণ তদারককারী এবং প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে নিয়মিত সম্মানী নেন। অভিযোগ উঠেছে, মো. আব্দুল লতিফ এত সব করছেন নিয়ম-নীতি না মেনে।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাজিরা খাতায় সই করতে হয়। আব্দুল লতিফও নিয়মিত সই করেন। এ বছরের মার্চ মাসের সাপ্তাহিক ছুটি এবং এক দিন সরকারি ছুটি ছাড়া বাকি সব দিন আব্দুল লতিফ অধিদপ্তরে উপস্থিত ছিলেন, এমন সই হাজিরা খাতায় আছে। ২২ থেকে ২৫ মার্চ—এই পাঁচ দিনও তিনি সই করেছেন। কিন্তু ভ্রমণ ভাতার কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, ২৩ থেকে ২৫ মার্চ তিনি বেশ কয়েকটি জেলা ভ্রমণ করেছেন। একটি বাসের টিকিটে দেখা যায়, ২২ মার্চ তিনি কুষ্টিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। টিকিটের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা। ভ্রমণ বিলে ঢাকা-কুষ্টিয়া খরচ লেখা ২ হাজার ৪০০ টাকা।

এরপর আব্দুল লতিফ কুষ্টিয়া থেকে যশোর, যশোর থেকে বাগেরহাট এবং ২৫ মার্চ বাগেরহাট থেকে ঢাকায় ফেরেন। এ ব্যাপারে আব্দুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কুষ্টিয়া, যশোর ও বাগেরহাট গিয়েছিলেন। কিন্তু অসাবধানতাবশত হাজিরা খাতায় সই করেছেন।

দখলে দুটি জায়গা

মূল কর্মস্থল ময়মনসিংহে হলেও নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর মো. আব্দুল লতিফকে একই সঙ্গে দুই জায়গায় সংযুক্তিতে রেখেছে। তিনি রাজধানীর মুগদা এলাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড নার্সিং এডুকেশনে শিক্ষক হিসেবে সংযুক্তিতে আছেন। আবার নার্সিং অ্যান্ড মিউওয়াইফারি এডুকেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস কর্মসূচির তিনি সার্বক্ষণিক ডেপুটি প্রোগ্রাম অফিসার (ডিপিএম)।

দুটি পদের দায়িত্বে থাকায় আব্দুল লতিফ একই সঙ্গে দুই জায়গা থেকে আবাসিক সুবিধা নিচ্ছেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড নার্সিং এডুকেশনের ডরমিটরিতে তাঁর আবাসন ব্যবস্থা করে দিয়েছে অধিদপ্তর। অন্যদিকে অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তাদের মতো ডিপিএম হিসেবে তাঁর আবাসনের ব্যবস্থা আছে শেরেবাংলা নগরে।

আব্দুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি থাকেন শেরেবাংলা নগরে। মুগদার ডরমিটরির বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে তাঁর বন্ধু থাকেন।

অনিয়ম খতিয়ে দেখা হবে এবং অনিয়ম প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মো. আলী নূর, সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থী

ডিপিএম হিসেবে প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্ব আব্দুল লতিফের। অধিদপ্তরের সব ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজনের সঙ্গে তিনি জড়িত থাকেন। কেন্দ্রে ও জেলা পর্যায়ে নার্সদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা হয়। কখনো তিনি প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী, কোনোটাতে প্রশিক্ষক। আবার কখনো প্রশিক্ষার্থী হিসেবে উপস্থিত থাকেন।

সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, আজকাল আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়েও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বা কর্মশালা হয়। প্রতিটি প্রশিক্ষণে ভাতা আছে। কাগজপত্রে দেখা যায়, আব্দুল লতিফ আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একই প্রশিক্ষণ একাধিকবার নিয়েছেন। যদিও তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ওই বিষয়ে তিনি একবারই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

অফিস আদেশে দেখা যায়, রাজধানীর নীলক্ষেতের জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমিতে এ বছরের ৩-১৫ এপ্রিল আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ হয়। একই বিষয়ে ২৩ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ হয়। দুটি প্রশিক্ষণেই প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে আব্দুল লতিফের নাম আছে।

যদিও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে এমন কর্মকর্তারা এই প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা।

আব্দুল লতিফ একজন ছাত্রকেও প্রশিক্ষকের তালিকায় রেখেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ওই ছাত্রের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা আছে।

করোনাকালে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নার্সদের অনেক প্রশিক্ষণ হয়েছে। গত ২২ মে থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত আইসিইউ বিষয়ে প্রশিক্ষণে ঢাকা শহরের আটটি বিশেষায়িত হাসপাতালের নার্সরা প্রশিক্ষণ নেন। এতে প্রশিক্ষক ছিলেন ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজের একজন শিক্ষার্থী। মো. আব্দুল লতিফ ওই কলেজের প্রশিক্ষক।

এসব বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারের বক্তব্য নেওয়ার জন্য এই প্রতিবেদক ২ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত অধিদপ্তরের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে অধিদপ্তর ভবনের পঞ্চম তলায় একটি কক্ষে ৩০ মিনিট বসিয়ে রাখা হয়। এরপর মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। তারপর বলা হয়, মহাপরিচালক মিটিংয়ে আছেন, মিটিং কখন শেষ হবে, তার ঠিক নেই। মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও মহাপরিচালকের সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর বলেন, অনিয়ম খতিয়ে দেখা হবে এবং তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।