পুরোনো জেএমবির একাংশ নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পুরোনো ধারার জঙ্গিদের একাংশ সংগঠিত হচ্ছিল। এই অংশের নেতা ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার।
এমদাদুল হক

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পুরোনো ধারার সদস্যদের একটা অংশ নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের একসময়কার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারের নেতৃত্বে এই অংশটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে সংগঠিত হচ্ছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য পেয়েছে।

এই জঙ্গিরা সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের জন্য ডাকাতির পরিকল্পনাও করছিল। এমনকি এক ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গত শুক্রবার ভোরে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বছিলা এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে (৫৫)।

র‌্যাব সূত্র জানায়, এমদাদুল হক জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবির প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য। তাঁর সঙ্গে জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের সখ্য ছিল। সেই সময় এমদাদুল ময়মনসিংহ এলাকার জেএমবির আঞ্চলিত নেতা ছিলেন। তবে সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহিনের নেতৃত্বে জেএমবির বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বনিবনা কম হচ্ছিল। এ কারণে পুরোনো ধারায় জেএমবি সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ৫০ জঙ্গিকে লক্ষ্যবস্তু করে কার্যক্রম শুরু করেন। এর মধ্যে ১১ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁর মধ্যে পাঁচজন এরই মধ্যে র‍্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন।

এ বিষয়ে র‍্যাব গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানায়। সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-২-এর সদস্য গত বুধবার মধ্যরাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত রাজধানীর বছিলায় অভিযান চালিয়ে ভাড়া বাসা থেকে এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে গ্রেপ্তার করে। সেখান থেকে পাঁচটি গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, টাকা, রাসায়নিক দ্রব্য ও দেশি তৈরি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে।

র‍্যাবের মুখপাত্র জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমদাদুল হক নতুন করে সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। তিনি ২০০৩ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকায় একটি ব্র্যাক অফিসে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ডাকাতি, নাশকতা, হত্যার অভিযোগে ঢাকা ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।

র‍্যাব সূত্র জানায়, এমদাদ ২০০৭ সালে তাঁর নিকটাত্মীয় রফিক মাস্টারকে হত্যায় জড়িত ছিলেন। গতকাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে এমদাদ র‍্যাবকে জানিয়েছেন, রফিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাঁদের বেশ কয়েকজন সদস্যকে ধরিয়ে দেন, এ কারণে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে রফিক মাস্টারকে হত্যা করা হয়।

এমদাদ র‍্যাবকে জানান, তিনি ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। দুই বছর পর স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কারণে শিক্ষকতার চাকরি হারান। এমদাদ ২০০২ সালে মুক্তাগাছায় সফররত এক জঙ্গি নেতার বয়ান শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর শায়খ আবদুর রহমানের কাছে বায়াত নেন এবং জামালপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এমদাদ। তিনি একপর্যায়ে জেএমবির ময়মনসিংহের আঞ্চলিক নেতা হন। জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ময়মনসিংহ সফরের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। নেতাদের গোপন আস্তানায় অবস্থান, বৈঠক ও বয়ান আয়োজনে ভূমিকা রাখতেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমদাদ র‍্যাবকে আরও জানান, তিনি ২০০৮ সাল থেকে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নাম পরিবর্তন করে আত্মগোপনে ছিলেন। এ সময় তিনি কখনো কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, কখনো ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক ও রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন। ২০১২ সালে ঢাকার উত্তরা থেকে তিনি গ্রেপ্তার হন। দুই বছর পর জামিনে বের হয়ে আবার জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হন। ২০১৫ সালে আবার বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তার হন। ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর বিভিন্ন ছদ্ম পরিচয়ে রাজবাড়ী, রংপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় অবস্থান করে জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সম্প্রতি ময়মনসিংহের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির সদস্য জুলহাজসহ ১০ জন ২০০৩ সালে এমদাদের কাছে বায়াত নিয়েছেন।

র‌্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তার জঙ্গি এমদাদ তাঁর বিশ্বস্ত ও পুরোনো জেএমবি সহযোগীদের সংগঠিত করে একটি গ্রুপ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এই গ্রুপটি ময়মনসিংহ, জামালপুর ও উত্তরবঙ্গসহ কয়েকটি জেলায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়াদি দেখার জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিযুক্ত করা হয়েছে। যাঁরা প্রশিক্ষণ, দাওয়াত ও রসদ ইত্যাদি বিষয় দেখেন। তবে অপারেশন বা মূল কার্যক্রম এমদাদ তদারকি করতেন। প্রথাগত দাওয়াতের পাশাপাশি সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধিতে তাঁরা করোনাকালের অনলাইনেও সক্রিয় ছিলেন। সংগঠনের অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য সদস্যদের ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত হওয়ার নির্দেশনাও দেন এমদাদ।

নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় থাকা এই গ্রুপটির বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে র‌্যাব।