পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে টাকার লেনদেন

পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগপ্রক্রিয়ায় আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সারা দেশে এই পদে ১০ হাজার লোক নিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা জেলার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হবে ৬৯৬ জনকে।
তবে ঢাকা জেলা কোটায় সর্বাধিকসংখ্যক নিয়োগ হবে বলে আগ্রহী প্রার্থীদের ভিড় বেশি। অনেক চাকরিপ্রত্যাশী ঢাকার বিভিন্ন উপজেলায় এক-দুই শতাংশ জমি কিনে এখানকার বাসিন্দা সেজে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার এখানকার আবেদনগুলো যাচাই-যাছাই হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই প্রার্থী সংগ্রহে মাঠে নামেন এলাকার সরকারি দলের নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এঁদেরই একজন ধামরাইয়ের গাওয়াইল গ্রামের সুরাইয়া আক্তার। তিনি গত বছর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান।
চাকরি দেওয়ার কথা বলে সুরাইয়া আগ্রহী প্রার্থীদের কাছে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সাংসদের সুপারিশে তাঁদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন তিনি।
ধামরাইয়ের জয়পুরা এলাকার এক নারী প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সুরাইয়া দুই লাখ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে সুরাইয়ার সঙ্গে গত শুক্রবার ওই চাকরিপ্রার্থী এবং এই প্রতিবেদকের ফোনে কথা হয়। সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো।
চাকরিপ্রার্থী: হ্যাঁ, সুরাইয়া আন্টি, কাল তো যেতে হবে, তো কত টাকা দিতে হবে?
সুরাইয়া: তুমি আপাতত তাড়াতাড়ি কইরা এক লাখ টাকা দেও। বাকি টাকা ১৮ ফেব্রুয়ারি দিবা।
চাকরিপ্রার্থী: চাকরি যে হবে, তার সিকিউরিটি (নিশ্চয়তা) কী?
সুরাইয়া: একদম শিউর।
চাকরিপ্রার্থী: কালকে কোথায় যাব?
সুরাইয়া: কালকে এমপি (ধামরাইয়ের সাংসদ এম এ মালেক) সাহেবের বাসায় নিয়ে যাব। তিনি মিষ্টিমুখ করাবেন এবং সিল মেরে সিরিয়াল দিয়ে দেবেন।
চাকরিপ্রার্থী: আচ্ছা, বাদিগাওয়াইল এলাকার একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ও কি টাকা দিয়েছে?
সুরাইয়া: হ্যাঁ, টাকা সবাই দিয়েছে। কেউ এক লাখ আবার কেউ দুই লাখ টাকাও দিয়েছে।
চাকরিপ্রার্থী: মোট কতজন?
সুরাইয়া: পাঁচ থেকে ছয়জন।
চাকরিপ্রার্থী: আমার আঙ্কেলের (এই প্রতিবেদক) সঙ্গে কথা বলবেন?
সুরাইয়া: দেও।
প্রতিবেদক: কেমন আছেন আপা?
সুরাইয়া: ভালো।
প্রতিবেদক: আচ্ছা, ও তো পুরো টাকা জোগাড় করতে পারছে না।
সুরাইয়া: আচ্ছা, সমস্যা নাই। আপাতত যা পারেন দেন, আমি আপাকে বুঝাইয়া বলব।
প্রতিবেদক: আপা কি এমপি সাহেবের স্ত্রী?
সুরাইয়া: হ্যাঁ, তিনিই তো মন্ত্রীদের ডান হাত আর বাম হাত। এমপি সাহেবেও থাকবেন, তবে আপাই ডিল করবেন।
প্রতিবেদক: এমপির প্রতিনিধি হয়ে আরও কেউ প্রার্থী সংগ্রহ করছেন কি?
সুরাইয়া: হ্যাঁ, প্রায় ইউনিয়নেই আছে।
কথোপকথনের পর থেকে সুরাইয়া এই প্রতিবেদককে বারবার ফোন করে টাকা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। একপর্যায়ে অন্য একটি ফোন থেকে সাংবাদিক পরিচয়ে এই প্রতিবেদক টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘কে বলছে এসব কথা? আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? পুলিশের চাকরির বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
জমি কিনলেই নাগরিক: নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা জেলার কোটায় কনস্টেবল পদে চাকরি পাওয়ার কথা ধামরাই, সাভার, দোহার, কেরানীগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দাদের। কিন্তু অন্য জেলার লোকজন এসব এলাকায় ১ থেকে ২ শতাংশ জমি কিনে এখানকার নাগরিক হিসেবে ঢাকা জেলার কোটায় চাকরিপ্রার্থী হয়েছেন। এঁদের কয়েকজন আরশেদ মিয়া, হাসান আলী, শাহীন মাতুব্বর, ইয়ামিন হোসেন ও শামীম আহাম্মদ। এঁরা গোপালগঞ্জ ও নড়াইলের বাসিন্দা হলেও সম্প্রতি ধামরাই থেকে জমি কিনে ঢাকা জেলার কোটায় প্রার্থী হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে নড়াইলের কালিয়ার ইয়ামিন হোসেন বলেন, তাঁর জেলায় জনবল নিয়োগ করা হবে মাত্র ৫৬ জন। কিন্তু প্রার্থী কয়েক শ। এ কারণে ঢাকা জেলার কোটায় চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কোনো টাকা লাগছে কি না, জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে ঢাকার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, চাকরির জন্য কোনো ব্যক্তিকে টাকা দিতে বারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে ঢাকা জেলার সব মসজিদে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর পরও ঘুষ দেওয়া বা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।