প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার আগেই টাকা তোলার চাপ

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় একটি প্রকল্প অনুমোদনের আগেই টাকা তুলে নিতে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিলে সই না করায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছেন ওই চেয়ারম্যানরা।
জানতে চাইলে খোকসার ইউএনও মোছা. সেলিনা বানু গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজে দেখেছি, কোথাও কোনো কাজ নেই। কোনো সাইনবোর্ড নেই, শ্রমিকদের রেজিস্ট্রার খাতা নেই, প্রচার-প্রচারণা নেই। তাঁরা এসে টাকা চাইলেন; তাঁদের খেয়ালখুশিমতো টাকা চাই। আমি সই করিনি।’
উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে খোকসার নয়টি ইউনিয়নে ১৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। উপজেলা প্রশাসন থেকে নয়টি ইউনিয়ন মিলে ১৯৬ জন অতিদরিদ্র মানুষের নামের তালিকা এবং তাঁদের ব্যাংক হিসাব সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে প্রকল্প প্রস্তাবও চাওয়া হয়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এলেও বেশির ভাগ চেয়ারম্যান প্রকল্প জমা না দিয়ে চলে যান। পরে খোকসা, ওসমানপুর, বেতবাড়িয়া, শিমুলিয়া, শোমসপুর, গোপগ্রাম, জয়ন্তীহাজরা ও আমবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা প্রকল্প জমা দেন। তবে এর মধ্যে ছয়টিতে উপকারভোগীর তালিকা আছে। অন্য দুটিতে উপকারভোগীর তালিকা থাকলেও তাঁদের কোনো ব্যাংক হিসাব নম্বর দেওয়া হয়নি। আর জানিপুর ইউপির চেয়ারম্যান আজ পর্যন্ত কোনো প্রকল্প জমা দেননি।
উপজেলা প্রশাসন বলছে, নিয়মানুযায়ী প্রথমে প্রকল্পটির অনুমোদন হতে হবে। এরপর সপ্তাহে চার দিন কাজ শেষে সপ্তাহান্তে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের হিসাবে টাকা চলে যাবে। চেয়ারম্যানরা কোনো টাকা তুলতে পারবেন না। কিন্তু এ প্রকল্পটি অনুমোদনের আগেই সংশ্লিষ্ট ইউপির চেয়ারম্যানরা ইচ্ছেমতো কাজ শুরু করেন। বাস্তবে তেমন কোনো কাজই হয়নি। যেসব প্রকল্পে কয়েক বছর আগে কাজ হয়েছে, সেই পুরোনো কাজকেই তাঁরা নতুন দেখিয়েছেন। আর নিয়ম ভেঙে তিন সপ্তাহের কাজের বিল একসঙ্গে অনুমোদনের জন্য তাঁরা ইউএনওকে চাপ দিচ্ছিলেন। গত বুধবার বিকেলে এক সভায় চেয়ারম্যানরা প্রকল্পের বিলে ইউএনও সেলিনা বানুকে সই দিতে বলেন। ইউএনও তাতে রাজি না হওয়ায় চেয়ারম্যানরা কার্যালয়ের বাইরে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ইউএনওর অসহযোগিতায় প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ইউএনও সেলিনা বানু বলেন, ‘তাঁদের (চেয়ারম্যানদের) প্রতারণা করে টাকাগুলো খেতে দিলাম না, এটাই হচ্ছে আমার অসহযোগিতা।...এখানে সবার প্রবণতা হচ্ছে, তাঁরা নিজের মতো করে কাজ করবেন, ইউএনও চুপ করে শুধু সই করবেন।’
অনিয়মের সত্যতা যাচাইয়ে এ প্রতিবেদক গতকাল সকালে দুটি প্রকল্প এলাকায় যান। শিমুলিয়া ইউপির ইসলামপুর সেতুর গোড়ায় মাটি ভরাট প্রকল্প তার একটি। সরেজমিন দেখা যায়, ওই প্রকল্প এলাকায় কোনো শ্রমিক নেই। সেতুর পূর্ব পাড়ে নামমাত্র মাটি ফেলা হয়েছে।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা প্রবাস সাহা বলেন, এখানে মাত্র ছয় দিন মাটি ফেলা হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরের আগেই সবাই বাড়ি চলে যেতেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য আশরাফের অনুরোধে তিনিও কয়েক দিন কাজ করেছেন। ১৪ জনের পরিবর্তে সেখানে ৮-৯ জন কাজ করতেন।
প্রকল্প অনুমোদনের আগেই কাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে শিমুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি কাজে শ্রমিক লাগিয়েছিলেন। শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৪ শ্রমিকের ব্যাংক হিসাব নেই, সেগুলো খোলা হবে।
খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বেতবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান বাবুল আখতারও দাবি করেন, তিনিও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার নির্দেশে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিলেন।
তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রকল্পের এখনো অনুমোদনই দেওয়া হয়নি। সেখানে চেয়ারম্যানদের কাজ করার নির্দেশ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ইউএনও সেলিনা বানু বলছেন, তিনি চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। অনিয়ম হওয়ায় ওই প্রকল্পের পুরো টাকা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, ‘সরকারি টাকা সরকারি হিসাবে জমা হবে। সরকার পুনরায় সংযুক্ত করে পাঠালে, নিয়মমতো কাজ করলে টাকায় সই করব; তা ছাড়া নয়।’