প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দুই সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১৫ জন নিয়েছেন ২৫ কোটি টাকা

প্রতীকী ছবি

জনতা ও রূপালী ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা আয় করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় সিআইডি গত ৭ জুন এই ব্যক্তিদের নামে বাড্ডা থানায় অর্থ পাচার আইনে মামলা করেছে। সিআইডি বলেছে, অন্তত ২৫০–৩০০ পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রির তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে তারা।

মামলার অনুসন্ধান কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপপরিদর্শক (এসআই) মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ মামলার এই আসামিরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাবসহ অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে এখন পর্যন্ত ২৫ কোটি টাকার অপরাধলব্ধ আয়ের তথ্য জানা গেছে।

যে দুজন ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অবৈধ টাকা আয়ের অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা হলেন জনতা ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শামসুল হক (শ্যামল) ও রূপালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানে আলম।

অপরাধলব্ধ আয়ের টাকা আসামিরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন, কেউবা কিনেছেন জমি।

গত বছরের নভেম্বরে দেশের পাঁচটি ব্যাংকের (সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ব্যাংক কর্মকর্তা জানে আলমসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। আসামিদের কাছ থেকে ব্যাংকের ‘অফিসার ক্যাশ’ পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র জব্দ করে পুলিশ। হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে আসামিরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন বলে পুলিশ জানায়।

ঢাকার আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

মামলায় এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি তদন্তের দায়িত্বে থাকা ডিবি পুলিশ।
তবে ব্যাংক কর্মকর্তা জানে আলমসহ অন্য আসামিদের পক্ষে লিখিতভাবে আদালতের কাছে দাবি করা হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অপরাধলব্ধ আয়ের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সঠিক নয়।

২৫ কোটি টাকা আয়

সিআইডি বলছে, ব্যাংক কর্মকর্তা জানে আলম ও শামসুল হক, আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির টেকনিশিয়ান মো. মোক্তারুজ্জামান, ল্যাব সহকারী মো. পারভেজ মিয়া, অফিস সহকারী মো. দেলোয়ার হোসাইনসহ ১৫ জন তিন বছর ধরে (২০১৮–২০২১) প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। এ সময়ে ২৫ কোটি টাকা আয় করেছেন তাঁরা। এই টাকা আসামিরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করাসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করেছেন।

মামলার বাদী মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে উপার্জিত আয়ের উৎস লুকাতে নামে-বেনামে সম্পত্তি করেছেন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অন্য আসামিরা। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের জমি কেনার তথ্য মিলেছে। কেউ কেউ বেনামে সম্পত্তি কিনেছেন। আসামিদের ব্যাংক হিসাব লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে আরও বিস্তারিত তথ্য আদালতে জমা দেওয়া হবে।

যে দুই ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে তাঁরা হলেন জনতা ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শামসুল হক (শ্যামল) ও রূপালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানে আলম।

তবে ডিবি পুলিশের মামলাসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন রূপালী ব্যাংকের জানে আলম, আহছানউল্লাহর দেলোয়ার, পারভেজ ও মোক্তারুজ্জামান। দেলোয়ার ছিলেন আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন (অফিস সহকারী)। ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার দায়িত্ব পায় এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্নপত্র ছাপা হতো আহছানিয়া মিশনের নিজস্ব ছাপাখানায়। সেখানে নজরদারি ও নিরাপত্তার অভাব ছিল। এ সুযোগে দেলোয়ার লুকিয়ে সেখান থেকে প্রশ্ন নিয়ে আসতেন। তিনি অন্তত চার–পাঁচটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এনেছিলেন। আর পরীক্ষার আগে রূপালী ব্যাংকের শামসুল হক প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর তা সমাধান করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ডিবির দায়ের করা পৃথক মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক শেখ লিয়াকত আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল, জানে আলমসহ অন্যরা ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেছেন। আসামিদের কাছ থেকে জব্দ করা মুঠোফোন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

ওই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরেনসিক প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে জানে আলমসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।’