‘বড় শিল্পপতি’ আমিনুর মানব পাচারে জড়িত

শেখ আমিনুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে তিনি পরিচয় দেন ‘বড় শিল্পপতি’ হিসেবে। নড়াইলের কথিত এই বড় ‘শিল্পপতি’ শেখ আমিনুর রহমান ওরফে হিমুর বিরুদ্ধে মানব পাচারে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ব্রুনেইয়ে মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে উত্তরা-পূর্ব থানার পুলিশ। গত ২৫ জানুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ২৪ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেনের হিসাব পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মানব পাচার ও প্রতারণার পৃথক তিনটি মামলার প্রধান আসামি আমিনুর রহমান জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। রোববার একটি মানব পাচার মামলায় তিনি ঢাকার আদালতে হাজিরও হন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উত্তরা-পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আসামি আমিনুর রহমান মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে। মানব পাচারের ভুক্তভোগীরা তাঁর ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠিয়েছিলেন, ব্যাংকের সেসব কাগজপত্র মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে সম্প্রতি তিনি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।

তবে কাফরুল থানায় করা মানব পাচার ও প্রতারণার অন্য দুটি মামলায় পুলিশ এখনো আদালতে অভিযোগপত্র দেয়নি বলে আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

তবে আমিনুর রহমান মানব পাচারে জড়িত থাকার কথা আদালতের কাছে অস্বীকার করেছেন। তাঁর পক্ষে আইনজীবী মোল্লা মনির আহমেদ লিখিতভাবে জানান, আমিনুর রহমান মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত নন। নয়জনকে ব্রুনেইয়ে পাঠানোর সঙ্গে তিনি জড়িত নন।

মোল্লা মনির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আমিনুর রহমান তিন মামলায় আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। মামলার শুনানির নির্ধারিত তারিখে তিনি আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন।

ব্রুনেইয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ৬০ জনের কাছ থেকে আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনে র‍্যাব।

মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আমিনুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। তাঁর বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়। অবশ্য এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর মানব পাচারের শিকার মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি আমিনুরসহ দুজনের বিরুদ্ধে ঢাকার মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে নালিশি মামলা করেন। আদালত ওই অভিযোগ এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য উত্তরা-পূর্ব থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। ওই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কাফরুল থানায় আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি প্রতারণার মামলা হয়।

আমিনুর রহমান গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে তিনি নড়াইল-২ (লোহাগড়া উপজেলা ও নড়াইল সদরের একাংশ) আসন থেকে দলীয় মনোনয়নও চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেলেও বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে সাংসদ ও বড় শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতেন বলে র‍্যাবের ভাষ্য।

ব্রুনেইয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ৬০ জনের কাছ থেকে আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনে র‍্যাব।

মানব পাচারে জড়িত আমিনুর

মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বরিশালের বেকার যুবক পলাশ হোসেনসহ নয়জনকে ২০১৯ সালের আগস্ট ও অক্টোবর মাসে ব্রুনেইয়ে পাঠান আমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মানব পাচার চক্রের সদস্যরা। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা করে মোট ২৭ লাখ টাকা নেয় চক্রটি। বাংলাদেশ থেকে ব্রুনেই যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা চরম হতাশ হন। তাঁদের যে কোম্পানিতে কাজ করার কথা, সেই নামে কোনো কোম্পানি সে দেশে নেই।

আসামি আমিনুর রহমান গুলশানের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মানব পাচারে জড়িত থাকার পাশাপাশি আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণারও অভিযোগ আছে।
মো. কামাল হোসেন

পলাশ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জমি বিক্রিসহ ধারদেনা করে আমিনুর রহমান ও তাঁর সহযোগী নূর আলমের কাছে তিন লাখ টাকা তুলে দেন। ব্রুনেইয়ে যাওয়ার আগে তাঁদের অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়। বলা হয়, সেখানকার কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরি পাবেন। কিন্তু ব্রুনেইয়ে যাওয়ার পর এমনও দিন গেছে, দুবেলা খাবার পাননি। এরপর পরিবারের সদস্যরা টাকা পাঠালে দেশে ফিরে আসেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আদালতের আদেশে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দেওয়া কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমিনুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে ভুক্তভোগীরা তিন লাখ টাকা জমা দেন। আর তাঁর সহযোগী নূরে আলমের ব্যাংক হিসাবে ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দেওয়া হয়। এই দুজনের পৃথক পৃথক ব্যাংক হিসাবে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত এই টাকা জমা দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, আসামি আমিনুর ও নূরে আলম টাকার বিনিময়ে মানব পাচারের ব্যবসা করে আসছিলেন। নামমাত্র রিক্রুটিং এজেন্সি দ্য হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স নজরুল ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসের মাধ্যমে ব্রুনেইয়ে ভুয়া কোম্পানি দেখান এই দুজন। আসামিদের প্রলোভনে পড়ে নয়জন মালয়েশিয়া হয়ে ব্রুনেইয়ে যান। আসামিরা সেখানে গিয়ে দেখেন, তাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তখন তাঁরা আমিনুর রহমান ও নূরে আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন আসামিরা ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আরও টাকা আদায় করেন। কিন্তু ব্রুনেইয়ে থাকা ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করেননি আসামিরা। আমিনুর ও নূরে আলম ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে নয়জনকে ব্রুনেইয়ে পাঠান।

মানব পাচারের শিকার আরেক ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী জিয়া মোল্লার অভিযোগ, পেশায় তিনি একজন ডিশ ব্যবসায়ী। আসামি আমিনুর রহমান ও নূরে আলম তাঁকে উচ্চ বেতনের লোভ দেখান। তাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ব্রুনেইয়ে পাঠানো হয়। পরে সেখানে তিনি ব্রুনেই পুলিশের হাতে আটক হন। পরে ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরে আসেন।

তদন্ত কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন জানান, আসামি আমিনুর রহমান গুলশানের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মানব পাচারে জড়িত থাকার পাশাপাশি আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণারও অভিযোগ আছে।