ভারতে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা আরও দুই তরুণীর মামলা

প্রতীকী ছবি

ভারতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা আরও তিন তরুণীর সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে দুই তরুণী মানব পাচার ও বিদেশে যৌনকর্মে বাধ্য করার অভিযোগে রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়সহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছেন।

শনিবার রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় তাঁরা এই মামলা করেন। তাঁদের মধ্যে এক তরুণীর বাসা মগবাজারের নয়াটোলা এবং আরেকজনের বাসা যাত্রাবাড়ীর কাজলায়। এ নিয়ে গত এক মাসে ভারতে পাচার হয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে পালিয়ে আসা চার তরুণী হাতিরঝিল থানায় মামলা করলেন।

হাতিরঝিল থানার পুলিশ জানায়, নয়াটোলার তরুণীর ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে। আর্থিক অসচ্ছলতার সুযোগ নিয়ে টিকটক হৃদয় তাঁকে টিকটক ভিডিও তারকা বানানোর কথা বললে তিনি রাজি হননি। টিকটক হৃদয় ভারতে সুপার মার্কেট ও বিউটি পারলারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দিয়েছিলেন। তরুণী বলেন, তাঁর ফুফু ভারতের মুম্বাইয়ে থাকেন। তাঁকে ফুফুর বাসায় পৌঁছে দিলে তিনি যাবেন বলে জানান। পরে টিকটক হৃদয় তাঁকে গত বছরের ১৮ মার্চ মুম্বাইয়ে নেওয়ার কথা বলে তাঁকেসহ তাঁর বান্ধবীকে সাতক্ষীরা সীমান্তে নিয়ে যান। টিকটক হৃদয় তাঁদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে বৈধ কাগজপত্র বানিয়ে মুম্বাইয়ে নেওয়ার কথা বলেন। টিকটক হৃদয়ের কয়েক সহযোগীর সঙ্গে তিন ঘণ্টা হাঁটার পর কাঁটাতারের বেড়ার একটি বড় ছিদ্র দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন তাঁরা।

তখন সেখানকার ইউপি সদস্যের আত্মীয় পরিচয়ে তাঁরা ছাড়া পান। দুই দিন সীমান্তে একটি বাড়িতে থাকার পর মেহেদী হাসান নামের একজন পাকা রাস্তা পার করে ভারতের সীমান্তে আরেক দালালের হাতে তুলে দেন। দালাল বকুল ওরফে ছোট খোকন তাঁদের দুজনকে দুই দিন রেখে ভারতের পরিচয় আধার কার্ড বা পরিচয়পত্র বানিয়ে দেন। পরে সেখান থেকে দালাল মণ্ডল তাঁদের বিমানে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে যান। সেখানে দালাল সাগর তাঁদের বেঙ্গালুরুর আনন্দপুর সার্কেলের একটি ভবনের তৃতীয় তলায় নিয়ে যান। সেখানে টিকটক বাবু ও তাঁদের কয়েকজন সহযোগীকে দেখেন। ওই বাসায় পাচারের শিকার বাংলাদেশি আরও কয়েকজন তরুণীকে দেখতে পান তাঁরা। সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, টিকটক হৃদয়, সাগর, অখিল, ডালিম, রুবেল ওরফে রুহুলসহ তাঁর সহযোগীরা মেয়েদের বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার আবাসিক হোটেল, ম্যাসাজ পারলারে পাঠিয়ে যৌনকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করেন। দুই তরুণী বিষয়টি পুলিশকে জানাতে চাইলে তাঁদের মারধর করা হয়।

ওই তরুণী বলেন, একপর্যায়ে টিকটক হৃদয় ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের জোর করে নেশাজাতীয় খাবার খাইয়ে যৌন নির্যাতন করে তার ভিডিও করেন। চক্রের সদস্যরা তাঁদের ভয় দেখিয়ে বলেন, কথা না শুনলে এসব ভিডিও তাঁদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এ সময় তাঁরা ফোনে পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা চাইলে বাংলাদেশে অবস্থানরত তাঁদের পরিবার দিতে রাজি হয়। যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়া বাংলাদেশি তরুণীর সহায়তায় গত ৫ মে কলকাতার সীমান্ত হয়ে দেশে পালিয়ে আসেন তিনি।

মে মাসের শেষ দিকে ভারতে এক বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে ওই তরুণীকে ঢাকার মগবাজারের রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় নির্যাতন করছেন এমন দেখা যায়। গত ২৭ মে টিকটক হৃদয়সহ ছয়জনকে ভারতের বেঙ্গালুরুর পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে ৭ মে পালিয়ে আসা তরুণীটি রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়সহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

যাত্রাবাড়ীর তরুণী গত বছরের ২০ নভেম্বর নুরজাহান ওরফে নদী ওরফে জয়া আকতার জান্নাত ওরফে ইতির মাধ্যমে ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাচার হন। সেখানের একটি পারলার থেকে গত ৬ মে পালিয়ে দেশে আসেন। তিনি বেঙ্গালুরুতে সাড়ে পাঁচ মাসের জিম্মিদশার বর্ণনা দিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, কলকাতা থেকে তাঁকে ট্রেনে বেঙ্গালুরুতে নেওয়া হয়। সেখানে থেকে দালাল তাসলিমা ওরফে বিউটির বেঙ্গালুরুর আনন্দপুরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর আপন বড় বোনকে দেখতে পান ওই বাসায়। এক দিন পর তাঁদের দুজনকে যৌনকর্মের জন্য পৃথক দুই বাসায় পাঠান। সেখানে দুই বোনই যৌন নির্যাতনের শিকার হন। হাতিরঝিল থানায় করা মামলায় তরুণী উল্লেখ করেন, তাঁকে বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও কেরালার ম্যাসাজ সেন্টারে ও আবাসিক হোটেলে পাঠানো হয়। গত ২ মে একটি ম্যাসাজ সেন্টারের জানালার কাচ ভেঙে পালিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় আসেন। সাতক্ষীরার সীমান্ত পেরিয়ে তিনি ৬ মে দেশে ফিরে আসেন।

পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. হাফিজ আল ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ভারতে নারী পাচার চক্রের সমন্বয়ক হলেন নুরজাহান। তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেলে পুরো চক্র সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, টিকটক ভিডিওর তারকা বানানোর ফাঁদে ফেলে এবং ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাচার হওয়া মেয়েদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন। এখন তাঁরা প্রত্যেককেই আইনি সহায়তা দিচ্ছেন।