মিলেমিশেই মেঘনায় ঘের

#মেঘনার বুকজুড়ে কয়েক শ ঘের দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘের মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত নুনেরটেক এলাকায়।
# প্রভাবশালী চক্রের লোকেরা সাধারণ জেলেদের মাছ ধরতে দেন না বলে অভিযোগ।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার নুনেরটেক এলাকায় মেঘনা নদীর বুকজুড়ে এভাবে বঁাশ পুঁতে ঘের তৈরি করে অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে একটি প্রভাবশালী চক্র। গতকাল সকালে
ছবি: দিনার মাহমুদ

কারখানা আর বর্জ্যের কারণে ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে এক দশক ধরে। এসব নদ-নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ হয়ে আড়াইহাজার উপজেলার বিষনাদী ফেরিঘাট এলাকায় মেঘনার পানি এখনো টলটলে স্বচ্ছ। যদিও কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য মেঘনায় ফেলা হচ্ছে। গজারিয়া থেকে বিষনাদী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেঘনায় নানা দেশি মাছ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে একটি প্রভাবশালী চক্র ওই ২৫ কিলোমিটার এলাকার মেঘনা নদীতে ডালপালা ও বাঁশ পুঁতে ছোট জাল ফেলে ঘের দিয়ে রাখছে। ওই চক্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি বিএনপির স্থানীয় নেতারাও রয়েছেন। তাঁরা সাধারণ জেলেদের মাছ ধরতে দেন না। এভাবে পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করায় মাছের অভয়াশ্রম নষ্ট হচ্ছে এবং দিনে দিনে মাছ কমছে বলে অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের।

স্থানীয় লোকজন জানান, মেঘনার ওই অংশে দেশীয় প্রজাতির কই, শিং, মাগুর, পুঁটি, রুই, কাতলা, শোল, কাঁচকি, বোয়াল, ট্যাংরা, বেলে, পাবদা, মলাসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে সোনারগাঁয়ের বৈদ্যেরবাজার ফিশারি ঘাটে এসব মাছ বিক্রি হচ্ছে। মেঘনার সুস্বাদু মাছের স্বাদ নিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে অনেক মানুষ প্রতিদিন বৈদ্যেরবাজার ফিশারি ঘাটে ভিড় জমান।

মেঘনার ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর বুকজুড়ে কয়েক শ ঘের (স্থানীয়ভাবে একে ঝোপ বলা হয়) দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘের দেওয়া হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত নুনেরটেক এলাকায়।

এভাবে মাছ না ধরলে মাছ পাওয়া যাবে না, এতে দোষের কী? বিএনপির আমলেও তাদের দলের নেতারা এভাবে ঘের দিত। এখনো বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী আমাদের সঙ্গে আছে।
মজিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়নের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা

স্থানীয় লোকজন জানালেন, সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার প্রশ্রয়ে তিন বছর ধরে একটি চক্র এ কাজ করছে। আলী আহম্মেদ নামের নুনেরটেক গ্রামের একজন জেলে জানান, নেতারা সিন্ডিকেট করে নদীতে ঘের দেওয়ার কারণে শত শত জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। ঘেরের কারণে তাঁরা নদীতে জাল ফেলতে পারছেন না। ঘেরের সামনে জাল ফেললে জেলেদের মারধর করা হচ্ছে।

বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রউফ জানান, প্রশাসনের চোখের সামনে মৎস্য আইন অমান্য করে মাছ ধরা হচ্ছে, অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাঁরা একাধিকবার বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।

সাত ভাইয়াপাড়া গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের একজন আলী হোসেন বলেন, একটি ঘের থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ পাওয়া যায়। লাভের অর্ধেক নেতাদের দিয়ে বাকি টাকা যাঁরা ঘের দেন, তাঁরা ভাগাভাগি করে নেন। এ হিসাবে প্রতিবছর কার্তিক, পৌষ ও মাঘ মাসে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

নদীতে চারটি ঘের দিয়েছেন নুনেরটেক গ্রামের বাসিন্দা হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি নদীতে চারটি ঘের দিয়েছি। এখান থেকে যে আয় হবে, তার অংশ কিছু লোককে দিতে হয়। তা ছাড়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপহার হিসেবে মাছ দিতে হয়।’ এভাবেই তাঁরা প্রতিবছর ঘের দিয়ে মাছ ধরছেন। এতে মৎস্য আইন লঙ্ঘন হয় কি না, তা তিনি জানেন না।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, অবৈধভাবে মাছ শিকার চক্রে রয়েছেন বারদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্মী মজিবর রহমান, মোক্তার হোসেন, আবুল হোসেন, হোসেন মিয়া, গোলজার হোসেন, আবদুল করিমসহ কয়েকজন। চক্রের সদস্যরা সবাই আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা। দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ার কারণে তাঁরা দলের কোনো পদে নেই।

এ ব্যাপারে কথা হয় সিন্ডিকেটের নেতা মজিবুর রহমান, হোসেন মিয়া ও গোলজার হোসেনের সঙ্গে। মজিবুর রহমান বলেন, ‘এভাবে মাছ না ধরলে মাছ পাওয়া যাবে না, এতে দোষের কী? বিএনপির আমলেও তাদের দলের নেতারা এভাবে ঘের দিত। এখনো বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী আমাদের সঙ্গে আছে।’

বারদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল হকও বললেন, ঘের দেওয়ার সিন্ডিকেটে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। আর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজহারুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আঁতাত করে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েছি।’

ঘের দিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে মাছ ধরা হলেও প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ নেই। সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতিকুল ইসলাম জানান, তিনি এ উপজেলায় সম্প্রতি যোগ দিয়েই কয়েকটি অভিযান চালিয়েছেন। মৎস্য কর্মকর্তাকে ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

তবে উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা জেসমীন আক্তার বলেন, যাঁরা ঘের দিয়ে মাছ ধরছেন, তাঁদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘এভাবে মাছ শিকার করলে সত্যিকার অর্থেই মাছের অভয়াশ্রমের ক্ষতি হয়। পোনা মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।’