রাজধানীর যত্রতত্র বাস টার্মিনাল শর্ত মানছেন না মালিকেরা
রাজধানীর অন্তত ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মোড় ও আবাসিক এলাকায় আইন না মেনে গড়ে উঠেছে স্থায়ী বাস টার্মিনাল। ফলে যানজট ও নাগরিক ভোগান্তি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা দিন চলার পর রাতে নগর পরিবহনের বাস চলে যাওয়ার নিয়ম গ্যারেজে। আর দূরপাল্লার বাসের চলাচল, যাত্রাবিরতি ও যাত্রী ওঠা-নামা—সবই হওয়ার কথা নির্ধারিত টার্মিনালে। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা এই আইন মানছেন না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশ যৌথভাবে নগর পরিবহন ও দূরপাল্লার পথের বাস চলাচলের অনুমতি দেয়। রাতে বাস কোন গ্যারেজে রাখা হবে—এ তথ্য নিশ্চিত করার পরই রাজধানীতে বাস চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। আর দূরপাল্লার পথে চলাচলের অনুমতি পেতে হলে রাজধানীর তিন টার্মিনাল—গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালীর যেকোনো একটিকে যাত্রা শুরুর কিংবা শেষ গন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করতে হয়।
বিআরটিএ ও পুলিশ সূত্র জানায়, সড়কে বাস রাখা হবে না—এই অঙ্গীকার বাসমালিকদের কাছ থেকে কাগজে-কলমে নেওয়া হয়। কিন্তু পরে তাঁরা সেটা মানছেন কি না, তা কেউ খতিয়ে দেখে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর অন্তত ১৬টি স্থানে সড়ক, সড়কের মোড় এবং আবাসিক এলাকা দখল করে রাতে বাস রাখা হয়।
দূরপাল্লার বাসগুলো সন্ধ্যার পরই নির্ধারিত টার্মিনাল ছেড়ে রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। এমন ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেখা গেছে, যেখানে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়। রাসেল স্কয়ার, কলেজগেট, মালিবাগ রেলগেট এলাকা ও রাজারবাগে এই দৃশ্য নিত্যনৈমিত্তিক। রাজধানীতে ছোট-বড় ছয়টি ডিপো থাকার পরও সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসও সড়কে রাখা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন যে পরিবহনমালিকেরা নিয়মটা মানছেন না। তবে তিনি দাবি করেন, ঢাকায় পরিবহন অবকাঠামো পরিকল্পিত নয়। এমনও আছে, এক ব্যক্তি একটিমাত্র বাসের মালিক। গ্যারেজ ভাড়া করে রাখতে গেলে ব্যবসা থাকবে না। এ অবস্থায় তিনি একাধিক মালিককে এক ছাতার মধ্যে নিয়ে এসে পরিবহনব্যবস্থায় সংস্কারের পরামর্শ দেন। তিনি দাবি করেন, এর মধ্যেও তাঁরা মামলা দিয়ে ও বুঝিয়ে মালিকদের আইন মানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
শর্ত কাগজে-কলমেই: রাজধানীতে বাস চালানোর অনুমতিপত্রের একটি অন্যতম শর্ত হিসেবে পরিবহন কোম্পানির নিজস্ব প্যাডে গ্যারেজের ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়।
বিআরটিএর নথি থেকে জানা গেছে, মিরপুর-আবদুল্লাহপুর পথে চলাচলকারী কনক পরিবহনের বাস রাখার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মিরপুর এমসিডব্লিউ রিফুয়েলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন। একই ফিলিং স্টেশনের ঠিকানা দিয়েছে আলিফ পরিবহনও।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওই ফিলিং স্টেশনটি মিরপুর সিরামিক ওয়ার্কসের একটি পাম্প। কনক ও আলিফ পরিবহনের প্রায় ৭৫টি বাস চলাচলের অনুমতি রয়েছে। অথচ ওই পাম্পে ২০টি বাস রাখারও জায়গা নেই। কনক পরিবহন নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খানের পারিবারিক কোম্পানি।
হিমাচল পরিবহনের বাস রাখার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ক/২৫৯ বাগবাড়ি, গাবতলী। এই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, এটি খালেক পরিবহনের নিজস্ব গ্যারেজ। সেখান থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পথে খালেক পরিবহনের বাস চলে। শ্রাবণী পরিবহনের আবেদনে বাস রাখার স্থান গাবতলী বললেও এই কোম্পানির বাসের কোনো গ্যারেজ পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে রাজধানীর যেসব স্থানে যত্রতত্র বাস রাখতে দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: আজিমপুর মেটার্নিটি হাসপাতাল, ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকা, পলাশী মোড়, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শিয়া মসজিদ, মিরপুর মাজার রোড, মিরপুর চিড়িয়াখানা রোড, টোলারবাগ, মিরপুর-১১ থেকে পল্লবী, কালশী রোড, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, বাহাদুর শাহ পার্ক, কমলাপুরের পীরজঙ্গি মাজার, খিলগাঁও তালতলা, খিলগাঁও উড়ালসড়কের উত্তর প্রান্ত।
রাজধানী ও এর আশপাশে ১৬৮টি পথে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাস চলাচলের অনুমতি রয়েছে। বেশির ভাগই রাতে রাখার স্থান হিসেবে পেট্রলপাম্প বা আবাসিক এলাকার ঠিকানা দিয়ে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। পেট্রলপাম্পে বাস রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হক বলেন, পাম্পে বাস রাখা বিপজ্জনক। কারণ, এতে নাশকতা ও দুর্ঘটনা—দুটিরই আশঙ্কা থাকে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পাম্পগুলোকে নির্দেশনা দিলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না।
পুরো ঢাকাই দূরপাল্লার বাসের টার্মিনাল: শুক্রবার রাত আটটা। পান্থপথের রাসেল স্কয়ারে দুই দিকের সড়ক দখল করে নয়টি বাস যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রিনলাইন, সোহাগ, এ কে ট্রাভেলস, ন্যাশনাল ট্রাভেলসের পাশাপাশি রয়েছে বিআরটিসির বাসও। কল্যাণপুর থেকে হানিফ, শ্যামলী, এস আর, ঈগলসহ ৫০-৬০টি কোম্পানির বাস দিনভর চলে। সন্ধ্যার পর তা বাড়তে বাড়তে শ্যামলী, কলেজগেট হয়ে আসাদগেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বড় বড় বাস সড়ক বিভাজকের কাটা অংশ দিয়ে পারাপার হতে গিয়ে দুই দিকেই যানজটের সৃষ্টি করে। মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, খিলগাঁও, আরামবাগ, কমলাপুর, মানিকনগরসহ কয়েকটি স্থানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সড়কে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় তো ২৪ ঘণ্টাই বাস চলাচল করে। আসলে গ্যারেজে রাখার সময়ও পাওয়া যায় না। দূরপাল্লার বাস শহরে আনা হয় যাত্রীদের সুবিধার জন্যই।