র‍্যাবের আটক দুজনকে অনেক আগেই তুলে আনা হয়েছিল?

>

র‍্যাবের হাতে আটক হওয়া পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গি। বাঁ দিক থেকে গাজী কামরুস সালাম, আবদুল হাকিম, রাজিবুল ইসলাম, শেখ মো. আবু সালেহ ও সোহেল রানা l ছবি: র‍্যাবের সৌজন্যে
র‍্যাবের হাতে আটক হওয়া পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গি। বাঁ দিক থেকে গাজী কামরুস সালাম, আবদুল হাকিম, রাজিবুল ইসলাম, শেখ মো. আবু সালেহ ও সোহেল রানা l ছবি: র‍্যাবের সৌজন্যে

*পাঁচ জঙ্গিকে আটক করেছে র‍্যাব * তিনজন আনসারুল্লাহ থেকে জেএমবিতে আসেন

র‍্যাব গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, এই পাঁচজন জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের সদস্য। তাঁদের মধ্যে তিনজন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম থেকে জেএমবিতে যোগ দিয়েছেন। একজন আনসারুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন।

এদিকে র‍্যাব গতকাল যেটাকে জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপ বলে উল্লেখ করেছে, একই জঙ্গি দলকেই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বলে আসছে ‘নব্য জেএমবি’। গত ২১ অক্টোবর র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনে ‘নব্য জেএমবি’ বলা হয়েছিল।

এই জঙ্গি দলটি গুলশান হামলাসহ দেশে যেসব হামলা বা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সেগুলোর দায় স্বীকার করেছে ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট)। আইএসের অনলাইন ম্যাগাজিন দাবিক-এ তাদের বাংলাদেশ শাখার প্রধানের নাম লিখেছিল শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। র‍্যাব বলছে, আশুলিয়ায় তাদের অভিযানে নিহত সারোয়ার জাহানই এই শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যদেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বুধবার রাত সোয়া আটটার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে আবদুল হাকিম ফরিদী ওরফে সুফিয়ান (৪০) ও রাজিবুল ইসলাম (২৯) নামের দুজনকে আটক করে র‍্যাব-২-এর একটি দল। এই দুজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে আদাবর এলাকার মোহাম্মদীয়া ক্যাফে থেকে অন্য তিনজনকে আটক করা হয়। তাঁরা হলেন গাজী কামরুস সালাম সোহান ওরফে আবু আবদুল্লাহ (২৭), সোহেল রানা ওরফে খাদেম ওরফে শহীদুল্লাহ ওরফে সোহেল (২৩) ও শেখ মো. আবু সালেহ ওরফে লিটন ওরফে হুরাইয়া (৪২)। তাঁদের কাছ থেকে একটি নাইন এমএম পিস্তল, ২০টি গুলি, ১০টি ককটেলসহ বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয় বলে র‍্যাব জানায়।

জানুয়ারিতে তুলে নেওয়া হয় রাজিবুলকে: আটক ব্যক্তিদের মধ্যে রাজিবুলের বাড়ি মাগুরায়। তিনি সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ফাইভ রিংস সিমেন্টের বিপণন কর্মকর্তা ছিলেন। র‍্যাব দাবি করেছে, রাজিবুলকে গত বুধবার রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে।

প্রথম আলোমাগুরা প্রতিনিধি জানান, রাজিবুলের ভাই রবিউল ইসলাম গতকাল বলেছেন, গত ২৭ জানুয়ারি রাজিবুলকে তাঁর সাতক্ষীরার তালার ভাড়া বাসা থেকে ধরে নিয়ে যান একদল লোক, যাঁরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়েছিলেন। এরপর থেকে পরিবার আর রাজিবুলের খোঁজ পায়নি।

রবিউলের দাবি, তাঁদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মাগুরায় তাঁদের গ্রাম থেকে রাজিবুলের বন্ধু মাসুদ মণ্ডলকে র‍্যাব ধরে নিয়ে যায়। এর পরপরই সাতক্ষীরা থেকে রাজিবুলকে তুলে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, রাজিবুল ঢাকা কলেজ থেকে অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর পাস করে সিমেন্ট কোম্পানিতে যোগ দেন।

গতকাল যোগাযোগ করা হলে ফাইভ রিংস সিমেন্টের কারখানা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় মোংলা (খুলনা) থেকে জানানো হয়, প্রায় এক বছর আগে তাদের কর্মী রাজিবুল নিখোঁজ হন। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তখন পুলিশকেও জানিয়েছিল।

র‍্যাব বলছে, রাজিবুল ঝিনাইদহের শহরের পাবলিক হেলথ মসজিদের মুয়াজ্জিন সোহেল রানার ঘরে এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকে জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহানসহ কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তাঁরা একটি থানায় হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। তবে কবে ওই বৈঠক হয়েছিল, তা বলেনি র‍্যাব।

জুনে ধরে নেওয়া হয় সোহেলকে: র‍্যাব বলছে, ঝিনাইদহের মসজিদের মুয়াজ্জিন সোহেল রানার বাসস্থান ও কর্মস্থল ছিল দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চরে জঙ্গিদের ‘সেফ হাউস’। থানা হামলার জন্য তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পান সোহেল। তাঁর কাছ থেকে থানার ডিউটি রোস্টার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ-সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে র‍্যাব। এ ছাড়া তাঁর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় গোপন নির্দেশনার চিঠিপত্র পাঠাতেন সারোয়ার জাহান।

প্রথম আলোঝিনাইদহের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সোহেল রানার ভাই মাসুদ রানা বলেছেন, চলতি বছরের ৩ জুন শুক্রবার জুমার নামাজের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে একদল লোক মসজিদের সামনে থেকে সোহেলকে তুলে নিয়ে যান। একটি কালো রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাসে করে তাঁকে নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে পরদিন ঝিনাইদহ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন মাসুদ রানা। জিডি নম্বর ১৪৫।

গত জুনেই মুয়াজ্জিন সোহেল রানাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে র‍্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অব্যাহত অভিযানের মুখে এ ধরনের অপরাধীরা দীর্ঘ সময় নিজেদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন বা পরিবারকে না জানিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। তখন তাঁদের পরিবার থেকে এ ধরনের অভিযোগ করা হয়।

আটক অন্যরা: র‍্যাব জানায়, আটক হওয়া বাকিদের মধ্যে গাজী কামরুস সালাম মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করার পর গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) লেখাপড়া করেন। পাস করে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিতে (ডেসকো) চাকরি নিয়েছিলেন।

ডেসকো থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়, প্রায় দুই বছর আগে দাপ্তরিক কোনো নিয়মনীতি না মেনেই হঠাৎ অফিসে আসা বন্ধ করেন কামরুস সালাম।

র‍্যাবের দাবি, আইইউটিতে পড়ার সময় সালাম তাঁর বন্ধু সিফাতের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে যুক্ত হন। অনলাইনে আনসারুল্লাহর মতাদর্শ প্রচারে যুক্ত ‘আত-ত্বামকীন মিডিয়া’ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওই সিফাত। তাঁকে গত ৯ আগস্ট র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। ওই সিফাত আইইউটিতে পড়ার সময় আনসারুল্লাহর প্রধান ও বর্তমানে কারাবন্দী মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান। র‍্যাবের দাবি, ওই সিফাতই পরে জেএমবির নেতা সারোয়ার জাহানের সঙ্গে সালামকে পরিচয় করিয়ে দেন।

র‍্যাব বলছে, কামরুস সালাম উত্তরবঙ্গে ১১ দিনের প্রশিক্ষণ নেন, এরপর চট্টগ্রামে ক্ষুদ্রাস্ত্র ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। তাঁর অন্যতম কাজ ছিল সমর্থকদের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করা এবং আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের সহযোগিতা করা। তাঁর কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শামীম, সাঈদ, রেজওয়ান, আমিনুল বেগ, সাইফ, শেলী, জাকির, সাইফুল্লাহর আত্মীয় ও নাম না জানা কয়েকজনের কাছ থেকে এই টাকা আদায়ের কথা উল্লেখ আছে।

র‍্যাব জানায়, আনসারুল্লাহ থেকে জেএমবিতে আসা আরেকজন আবদুল হাকিম ভালো বক্তা ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক। আনসারুল্লাহর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা এই ব্যক্তি জসীমউদ্দিন রাহমানির সঙ্গেও বক্তৃতা দিয়েছেন। জসীমউদ্দিন রাহমানি গ্রেপ্তার হওয়ার পর একপর্যায়ে তিনি রাহমানির স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন।

র‍্যাবের দাবি, জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে একজন ভালো বক্তার খুব প্রয়োজন ছিল, যিনি বক্তব্যের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেন। তখন সারোয়ার জাহান দূত পাঠান এই আবদুল হাকিমের কাছে। হাকিম প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জেএমবিতে যুক্ত হন। হাকিমের পরিচিতির ক্ষেত্রটা ছিল বিস্তৃত। তিনি চট্টগ্রামের হাবিবুর রহমান শেখ ওরফে তৌহিদ নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নাশকতার কাজে ব্যবহারের অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন।

তবে র‍্যাব আবদুল হাকিমের গ্রামের যে ঠিকানা গণমাধ্যমকে দিয়েছে, সে অনুযায়ী কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ওই গ্রামে গিয়ে এর সত্যতা পায়নি প্রথম আলোকিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি। এ বিষয়ে পরে জানতে চাইলে র‍্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ বলেন, তাঁরা প্রাথমিকভাবে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এগুলো চূড়ান্তভাবে যাচাই করা হয়নি।

এই হাকিমের মাধ্যমে গত বছর জেএমবিতে যোগ দেন রাজিবুল ইসলাম। এই রাজিবুল ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জসীমউদ্দিন রাহমানির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন বলে র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।

আনসারুল্লাহ থেকে জেএমবিতে?: এর আগ পর্যন্ত পুলিশ ও র‍্যাবের কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, জেএমবি ও আনসারুল্লাহর মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব বা পার্থক্য রয়েছে। গত ২১ অক্টোবর র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনে নব্য জেএমবির প্রধানের যেসব চিঠিপত্র দেখানো হয়েছিল তাতে বলা হয়, নব্য জেএমবির ‘খিলাফতের’ যৌক্তিকতা প্রত্যাখ্যান ও এর বিরোধিতা করছে আল-কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ। আর গতকাল র‍্যাব বলেছে, তাদের হাতে আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন আনসারুল্লাহ থেকে জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে যোগ দেন।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, তাদের (জঙ্গিদের) নীতিগত কিছু বিষয় রয়েছে। তবে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে মনে হয় একসঙ্গে মার্চ করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি না সাংগঠনিকভাবে আনসারুল্লাহর লোকজন জেএমবিতে যোগ দিচ্ছে। কিছু বিচ্ছিন্নভাবে হতে পারে।’ তিনি বলেন, এখানে নব্য জেএমবির সদস্যরা আইএসের অনুসারী আর আনসারুল্লাহর সদস্যরা আল-কায়েদাকে অনুসরণ করেন। দুই দলের লক্ষ্য এক, কিন্তু পন্থা ভিন্ন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আল-কায়েদা থেকে আইএসে যোগ দেওয়ার খবরও এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বরং এখন আইএসের চেয়ে সিরিয়ায় নুসরা ব্রিগেড (আল-কায়েদা মতাদর্শের) শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আল-কায়েদা ভাবছে, আইএস নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে এর সদস্যদের তারা টেনে নেবে।