লেকহেড স্কুলের সঙ্গে জঙ্গির যোগসূত্র পুরোনো

দেশে এখন নিষিদ্ধ তিনটি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে ঢাকার লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষসহ অন্তত পাঁচজন শিক্ষক ও একজন কর্মকর্তার যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে দুজন শিক্ষক ছিলেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাতৃসংগঠন জামায়াতুল মুসলেমিনের ও দুজন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে যুক্ত। অপর এক শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আইএস মতাদর্শী নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত।
তাঁদের মধ্যে স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জেনিফার আহমেদ ও গণিত শিক্ষক মনিরুজ্জামান মাসুদ হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে, শিক্ষক তেহজীব করিম ও মাঈনুদ্দীন শরিফ জামায়াতুল মুসলেমিন, আহমেদ ওয়াদুদ জুম্মান ওরফে সাইফুল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং শিক্ষক জুবায়দুর রহমান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম (সম্প্রতি নিহত) নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বছর ছয়েক আগে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে অধ্যক্ষসহ এই স্কুলটির যোগসূত্রের বিষয় জানা যায়। স্কুলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, লেকহেড গ্রামার স্কুলের উদ্দেশ্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মনে তাঁর মুসলিম পরিচয় গেঁথে দেওয়া এবং সারা জীবন যেন সে এই বিশ্বাস ধরে রাখে। অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সন্তানকে ‘আল্লাহর খলিফা’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে যেন সে সত্যিকারের ইসলামি বিশ্ব গড়ে তোলায় সহযোগিতা করতে পারে।
২০১০ সালের মাঝামাঝির কথা। ওই বছরের শুরুতে ইয়েমেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হন কিছু বাংলাদেশি যুবক। পরে তাঁরা দেশে ফিরে আসেন। তাঁদের মধ্যে দুজন তেহজীব করীম ও মাঈনুদ্দীন শরিফ ছিলেন ধানমন্ডির লেকহেড গ্রামার স্কুলের শিক্ষক।
মাঈনুদ্দীনের আরেক ভাই রেজোয়ান শরিফও ইয়েমেনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁরা সবাই আল-কায়েদার আরব উপদ্বীপের নেতা আনওয়ার আওলাকির অনুসারী ছিলেন বলে তখন ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছিলেন। এর মধ্যে তেহজীবের বড় ভাই রাজীব করীম ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও পরে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের কারাগারে সাজা ভোগ করছেন।
বর্তমানে মাঈনুদ্দীন শরিফ, রেজোয়ান শরিফ ও তেহজীব নিরুদ্দেশ। তেহজীবের বাবা জয়নুল করিম অবশ্য প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তেহজীব থাইল্যান্ডে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষকতার ওপর একটি কোর্স শেষ করে ১৭ মে বিকেলে দেশে ফেরার পর ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। মাঈনুদ্দীন ও তাঁর ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
মাইনুদ্দীনের সঙ্গে ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর বাসার সামনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি ২০০৯ সালে ইয়েমেন যাওয়ার আগ পর্যন্ত লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষক ছিলেন।
আল-কায়েদা বা আনওয়ার আওলাকির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল কি না, জানতে চাইলে মাঈনুদ্দীন বলেছিলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’ তবে তেহজীব ও তাঁর ভাই যুক্তরাজ্যে গ্রেপ্তার হওয়া রাজীব করিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন তিনি।
পরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, মাঈনুদ্দীন ও তেহজীব করীমেরা জামায়াতুল মুসলেমিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনটি পরবর্তী সময়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং সর্বশেষ আনসার আল ইসলাম নাম ধারণ করে। সংগঠনটি নিজেদের আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা বলে দাবি করে।
বর্তমানে স্কুলটির সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, শুরু থেকে লেকহেড স্কুলকে হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলটির একটি সূত্র বলছে, ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুসরণ করা হলেও, তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক বই পড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে হিযবুত তাহ্রীর যেভাবে ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যা দেয় তেমন ব্যাখ্যাসংবলিত বইও পাঠ্যক্রমে যুক্ত ছিল। এ নিয়ে তৎকালীন আরেক গোপন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুসলেমিনের সঙ্গে যুক্ত তেহজীব করীম ও মাঈনুদ্দীন শরিফদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। যার জের ধরে তাঁরা একপর্যায়ে স্কুলটির চাকরি ছেড়ে দেন।
২০০০ সালে ধানমন্ডির ৬এ সড়কে স্কুলটির যাত্রা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন জেনিফার আহমেদ। তিনি এ দেশে হিযবুত তাহ্রীরের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী। জেনিফার নিজেও হিযবুতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্কুলটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন জেনিফার আহমেদের বাবা লতিফ আহমেদ।
লেকহেড গ্রামার স্কুলের বর্তমান অধ্যক্ষ মমিতা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেনিফার আহমেদ ২০০৯ সালে অধ্যক্ষের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তবে তিনি স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ছিলেন। প্রায় ১০ মাস আগে তিনি পুরোপুরি তাঁর মালিকানা প্রত্যাহার করে নেন। তাঁর জায়গায় স্কুলটির পূর্ণ দায়িত্ব নেন হারুন-অর-রশীদ, যিনি হারুন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী। এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে তাঁর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে হারুন-অর-রশিদ বা তাঁর পরিবারের কারও কোনো ফোন নম্বর দিতে রাজি হননি কেউ।
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ করার পর আবার আলোচনায় আসে লেকহেড স্কুল। এরপর জেনিফার আহমেদ স্কুলের অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দেন। ওই সময় হিযবুত তাহ্রীরের যেসব নেতা গ্রেপ্তার হন তাঁদের মধ্যে লেকহেড গ্রামার স্কুলের গণিত শিক্ষক মনিরুজ্জামান মাসুদও ছিলেন।
২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের গুরুত্বপূর্ণ এক জঙ্গিকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর নাম আহমেদ ওয়াদুদ জুম্মান ওরফে সাইফুল ওরফে ডেইজ ওরফে অর্ণব। পরদিন ১১ নভেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের সংবাদ পোর্টাল ডিএমডি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে জুম্মান পুলিশকে জানান, তিনি ২০১২ সালে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। ওই বছরই তিনি লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি আল-কায়দার সাময়িকী ‘ইন্সপায়ার’-এর পঞ্চম খণ্ড বাংলায় অনুবাদ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ‘জঙ্গি বক্তব্য’ বাংলায় অনুবাদ করতেন, যা পরে আনসারুল্লাহর বিভিন্ন ব্লগে পোস্ট করা হতো।
গত ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর যে দশজন সন্দেহভাজন নিখোঁজ যুবককে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরিবারের পক্ষ থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয় তাঁদের মধ্যে ধানমন্ডির জুবায়দুর রহমান লেকহেডের শিক্ষক এবং পান্থপথের আশরাফ মো. ইসলাম ছাত্র ছিলেন।
সর্বশেষ ঢাকার রূপনগরে পুলিশের অভিযানে মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম নিহত হওয়ার পর স্কুলটি আবার আলোচনায় আসে। জাহিদ সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে গত ডিসেম্বরে এই স্কুলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। পুলিশ বলছে, এই জাহিদ গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। মেজর (অব.) জাহিদ মার্চ পর্যন্ত লেকহেড স্কুলে চাকরি করেন।
ধানমন্ডির বাইরে মোহাম্মদপুর, বনানী ও গুলশানে স্কুলটির তিনটি শাখা খোলা হয়। এর মধ্যে বনানী শাখা এখন বন্ধ। এ ছাড়া ধানমন্ডি শাখা ১১এ সড়কে স্থানান্তরিত হওয়ার পর আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করার দায়ে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্ধ করে দেন। স্কুলটির এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৪০০।
স্কুলের অধ্যক্ষ মমিতা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে স্কুলটি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। হয়তো কিছুটা সত্যতাও ছিল। এখন আমরা সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করছি।’
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে এগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে।