লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা

অভিজিৎ রায় l ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি
অভিজিৎ রায় l ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনি খুন হন। বইমেলাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। 
প্রায় এক দশক আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একইভাবে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। আর গতকাল ২৬ ফেব্রুয়ারি খুন হলেন অভিজিৎ রায়। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।
অভিজিতের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রাফিদা আহমেদ। এ সময় তিনিও গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাফিদা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রাত সাড়ে আটটার দিকে একুশে বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে ফুটপাতে চা-পানের জন্য তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাত পৌনে নয়টার দিকে যুবক বয়সের দুই দুর্বৃত্ত অতর্কিতে চাপাতি দিয়ে পেছন থেকে অভিজিৎকে কোপাতে থাকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী তাঁকে রক্ষা করতে গেলে দুর্বৃত্তরা তাঁকেও কোপ দেয়। এরপর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে কয়েকজন ফটোসাংবাদিক রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
কর্তব্যরত চিকিৎসক সোহেল আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে অভিজিৎ (৪২) মারা যান। রাফিদার (৩৫) মাথায় চাপাতির চারটি আঘাত লেগেছে। তাঁর বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। অভিজিৎ ‘মুক্তমনা’ ব্লগের সম্পাদক ও লেখক। ‘কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে’ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম পদক পায় মুক্তমনা। তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। রাফিদা আহমেদ লেখালেখি করেন বন্যা আহমেদ নামে। অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, বিশ্বাসের ভাইরাস।
হাসপাতালে অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিৎ রায় প্রথম আলোকে বলেন, অভিজিৎ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করার পর সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। আট বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার প্রকৌশলী তিনি। ২০০৮ সালে তিনি রাফিদাকে বিয়ে করেন। এ বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। আগামী মাসে স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা। দুই ভাইয়ের মধ্যে অভিজিৎ বড়।
অভিজিতের কয়েকজন ঘনিষ্ঠজনদের অভিযোগ, লেখালেখি করার কারণে তাঁকে বিভিন্ন সময় ব্লগ ও ফেসবুকে হুমকি দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে শফিউর রহমান ফারাবী নামে এক ব্যক্তিও রয়েছেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে অভিজিৎ প্রতিদিন বইমেলায় যেতেন বলে তাঁর ভাই ও বন্ধুরা জানিয়েছেন। তাঁদের ধারণা, এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে হামলাকারীরা তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।
হামলার ঘটনাস্থলে রাত পৌনে ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি মোটরসাইকেল কাত হয়ে পড়ে আছে। ঘটনাস্থল ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। ফুটপাতে রক্ত পড়ে আছে। কিছু মগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। পরে পুলিশ হলুদ ফিতা দিয়ে ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে।
প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী জানান, তিনি দুজনকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট থেকে এ পর্যন্ত দৌড়ে আসতে দেখেছেন। তাদের পেছনে আরও দুই-তিনজন ছিল। সঙ্গে ছিল ধারালো অস্ত্র। পরে এখানে এসে দেখেন দুই নারী-পুরুষ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, একটি মেয়ে আহাজারি করছে আর কয়েকজন তাঁদের ঘিরে রেখেছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তাও সেখানে ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে ঘটনাস্থলের কয়েক গজের মধ্যে পুলিশের একটি ভ্যান রাখা ছিল।
ফুসকা বিক্রেতা আবুল কাশেম জানান, দুর্বৃত্তদের একজন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের দিকে, আরেকজন মিলন চত্বরের দিকে পালিয়ে যেতে তিনি দেখেছেন।
ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অপরাধ শনাক্তকরণ দল ঘটনাস্থলে আলামত সংগ্রহ করে। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা দুটি চাপাতি ও কাঁধে ঝুলানো একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। দুটি চাপাতির হাতল কাগজে মোড়ানো ছিল। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ তাৎক্ষণিক নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হতাহতের খবরে অভিজিতের বাবা, ভাই, স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। এ সময় কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে রাত ১২টা পর্যন্ত অভিজিতের বাবা অজয় রায়কে ছেলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি।
রাতে হাসপাতালে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তর সালে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে, সেভাবেই মৌলবাদীরা দেশে যাঁরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, তাঁদের ওপর হামলা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, বহিরাগত সন্ত্রাসীরা তাঁদের কুপিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওই এলাকায় পুলিশ সব সময়ই থাকে। তবে কেউ যদি কাউকে লক্ষ্য করে হত্যা করতে চায়, তবে তা ঠেকানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। তবে কে কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব হবে না।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে অন্তত পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছেও দুটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ সমাবেশ: অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে হাসপাতালে হাজির হন শতাধিক শিক্ষার্থী। কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল করে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। এ ছাড়া ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। মেয়েদের হলের ভেতরে মিছিল করেছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো। আজ সকাল ১০টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন বিক্ষোভ-সমাবেশ আহ্বান করেছে। একই সময়ে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ অবস্থান করবে।