হদিস নেই ১১ কেজি সোনার

তিনটি সংস্থার ৮ কর্মকর্তা ৯ বছর ধরে তদন্ত করেছেন। পাওয়া গেছে শুধু ‘চোরাচালানির’ ঠিকানা।

  • আকবর নামের এক ব্যক্তি দুবাই থেকে ফেরার সময় ১১ কেজি সোনা উড়োজাহাজের আসনের নিচে রেখে আসেন।

  • সেই সোনা কোথায় গেল, তা বের করা যায়নি।

ফাইল ছবি

পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ৮ কর্মকর্তা ৯ বছর ধরে তদন্ত করেও একটি মামলায় ১১ কেজি সোনার হদিস বের করতে পারেননি। ধরতে পারেননি ‘মূল চোরাচালানি’কেও। এই দীর্ঘ সময়ের তদন্তে শুধু আসামির ঠিকানা বের করা সম্ভব হয়েছে।

এই মামলায় সম্প্রতি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। ওই দিন রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন মোহাম্মদ আকবর হোসেন নামের এক ব্যক্তি। শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আকবরের ব্যাগ তল্লাশি করে ১১ কেজি সোনা কেনার রসিদ খুঁজে পান। জিজ্ঞাসাবাদে আকবর স্বীকার করেন, ইমরান আহমেদ ওরফে সবুজ নামের এক ব্যক্তির কথামতো তিনি উড়োজাহাজের একটি নির্দিষ্ট আসনের নিচে সোনার বারগুলো রেখে নেমে এসেছেন।

এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) আইনে মামলা হয়। মামলায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দেওয়া অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, আকবর ও ইমরান দুজনই সোনা চোরাচালানের ব্যবসায় জড়িত। দুজনের বাড়িই চট্টগ্রামে। আকবর জামিনে রয়েছেন। তাঁর আইনজীবী লিখিতভাবে আদালতের কাছে দাবি করেছেন, তিনি নির্দোষ।

মামলাটির সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত করে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তার ওপর ভিত্তি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।

নথিপত্র বলছে, মামলাটি প্রথমে প্রায় আট মাস তদন্ত করে বিমানবন্দর থানার পুলিশ। পরে তদন্তভার পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাটি দুদকের কাছে ছিল দুই বছরের মতো। তবে চোরাচালান ও শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ দুদকের আওতাধীন (তফসিলভুক্ত) না হওয়ায় ২০১৬ সালে এই মামলার তদন্তভার যায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কাছে। এই সংস্থার চার তদন্ত কর্মকর্তা ছয় বছর তদন্ত করেছেন।

মামলার অভিযোগপত্রে দেখা যায়, বিমানের আসনের নিচে আকবরের রেখে যাওয়া সোনা কে বা কারা বিমানবন্দর থেকে বাইরে আনলেন, সে তথ্য উল্লেখ নেই।

২০১৮ সালে আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন সেই সময়ে তদন্তের দায়িত্বে থাকা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বিটন চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার অন্যতম আসামি ইমরানকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে আরও অনেক তথ্য জানা সম্ভব হতো।’

বারবার বিদেশে যেতেন আকবর

আকবরের পাসপোর্টের তথ্য পর্যালোচনা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, আকবর ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে একই বছরের ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তিনবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গেছেন। তিনি বারবার দুবাই গিয়ে অবৈধ পন্থায় টাকা পাচার করে সেখান থেকে সোনা কিনে দেশে আনেন।

ইমরানের অপরাধ বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ইমরান আহমেদ একটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এর ১৬ দিন পর তিনি নিজের আরেকটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর শারজাহে চলে যান। ওই বছর ইমরান ৬ মাসের মধ্যে ১০ বার দেশের বাইরে গেছেন।

আদালতে জমা দেওয়া শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, ইমরান অধিকাংশ সময় দুবাইয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে তিনি বাংলাদেশে আসেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানা-পুলিশের মাধ্যমে হাজির হতে বলা হলেও তিনি আসেননি। ২০১২ সাল থেকে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তবে সর্বশেষ জমা ছিল মাত্র ৪ হাজার ৫৯৪ টাকা।

‘বিষয়টি দুঃখজনক’

এদিকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা অনুযায়ী, অর্থ পাচার মামলায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হয় ১০৫ দিনের মধ্যে। তবে তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সময়সীমা বাড়াতে পারেন।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, আইনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া উচিত। তাতে বাদী ও বিচারপ্রার্থী উভয়ের লাভ। ৯ বছর ধরে একটি মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক।