হামলা থামছে না

এবার রংপুরের কাউনিয়ায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে মাজারের এক খাদেমকে। আর ফরিদপুরে পোশাক (ইউনিফর্ম) পরা এক কারারক্ষীকে ক্ষুর দিয়ে পিঠে পোঁচ দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
গত মঙ্গলবার ঢাকার কচুখেতে একজন মিলিটারি পুলিশকে (এমপি) কুপিয়ে গুরুতর জখম করার ৩০ ঘণ্টার মধ্যে এ দুটি ঘটনা ঘটল। গত ৩ অক্টোবর রংপুরের এই কাউনিয়া উপজেলাতেই জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সতর্ক অবস্থানের মধ্যে এসব হামলার ঘটনা ঘটছে। গত ৪৪ দিনে এ ধরনের ১২টি হামলা হয়েছে। এতে দুই বিদেশি, দুই পুলিশ সদস্য, একজন প্রকাশকসহ নয়জন নিহত এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এসব হামলা পরস্পর সম্পর্কিত, বলা যায় ‘একই সুতোয় গাঁথা’।
দুই বিদেশি হত্যার পর বাংলাদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর আবারও ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁদের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে।
রংপুরের আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রংপুরের কাউনিয়ায় নিহত রহমত আলীর বাড়ি উপজেলার টেপা মধুপুর ইউনিয়নের বাজেমুশকুর গ্রামে। স্থানীয় চৈতার বাজারে তাঁর ওষুধের দোকান আছে। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে দোকান বন্ধ করে তিনি হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিলেন। ২০০ গজ যাওয়ার পরে চৈতার মোড়ে দুর্বৃত্তরা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ফেলে যায়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে রাতেই পুলিশ গিয়ে তাঁর লাশ উদ্ধার করে।
কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম জাহিদুল ইসলাম বলেন, চৈতার মোড়ে বাবা আবদুস সাত্তারের নামে একটি মাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রহমত আলী। সেখানে সুরেশ্বর দরবার শরিফের নামে একটি দরবারও আছে। সেখানকার খাদেম ছিলেন রহমত আলী। রহমত আলী তাঁর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর ২১ নভেম্বর সেখানে ওরস করে থাকেন। এ বছরও ওরসের আয়োজন চলছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে বসে আধ্যাত্মিক গানের আসর।
রহমত আলী পীর-মাজারবিরোধীপন্থীদের হাতে খুন হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন রংপুরে পুলিশের কর্মকর্তারা। আরেকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রংপুর অঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার ধরন দেখে মনে হয়েছে, মতাদর্শিক দ্বন্দ্বেই এ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় খিজির খানসহ আট হত্যার ঘটনার সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
নিহত ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রহমত আলীর মাথা ও ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের জখম রয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা হলেন উপজেলার টেপা মধুপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সদস্য মোরশেদ আলী (৩৬) ও শহিদুল ইসলাম (৩৫)। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
কারারক্ষীর ওপর হামলা: গতকাল দুপুরে ফরিদপুর শহরে মোটরসাইকেলে করে কারাগারের ডাক নিয়ে যাওয়ার সময় কারারক্ষী আসাদুজ্জামানের পিঠে ক্ষুর দিয়ে আঘাত করে হামলাকারী পালিয়ে গেছে। গতকাল রাজধানীতে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন।
তবে ফরিদপুরের পুলিশ ও ফরিদপুর কারা কর্মকর্তারা অন্য কথা বলছেন বলে জানায় আমাদের ফরিদপুর অফিস। ফরিদপুর কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কারারক্ষীকে ক্ষুর দিয়ে জখম করার কোনো ঘটনা ঘটেনি। মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে তিনি সামান্য আহত হয়েছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি কর্তব্য পালন করছেন।
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘খবর শুনে আমরা সত্য উদ্ঘাটনের বহু চেষ্টা করেছি। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ যদি অভিযোগ না করে, তাহলে আমাদের কিছুই করার থাকে না।’
জখমপ্রাপ্ত কারারক্ষী আসাদুজ্জামান গতকাল বুধবার বেলা পৌনে দুইটার দিকে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাহীন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, কারারক্ষীর পিঠে চোখা কোনো বস্তুর আঘাত ছিল। দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১০ সেন্টিমিটার, তবে আঘাত গভীর নয়। এটা দায়ের কোপেও হতে পারে, আবার মোটরসাইকেলের কোনো সরু যন্ত্রের আঘাতেও হতে পারে।
আসাদুজ্জামানকে গতকাল বিকেল চারটার দিকে জেলখানার কারারক্ষীদের কোয়ার্টারে পাওয়া যায়। একটি গামছা দিয়ে শরীরের ব্যান্ডেজ করা ক্ষতস্থান ঢাকা ছিল। আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, বেলা দেড়টার দিকে তিনি আরেক কারারক্ষী জাহিদুল ইসলামকে নিয়ে ফরিদপুরের প্রধান ডাকঘরে চিঠি দিতে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি রিকশার সঙ্গে তাঁদের মোটরসাইকেলটি ধাক্কা খেলে তিনি তারকাঁটার ওপর পড়ে গিয়ে পিঠে আঘাত পান।
ফরিদপুরের কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ফরিদপুর প্রধান ডাকঘরের মূল ফটকের বাঁ পাশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাতে এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আসাদুজ্জামান।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, মুজিব সড়কে অবস্থিত ডাকঘরের পূর্ব দিকে (বাঁ পাশে) আনুমানিক ১০০ মিটার দূরে স্টেশন রোডের মোড়ে কয়েকটি স্টেশনারি ও চায়ের দোকান আছে। ডাকঘরের দক্ষিণ দিক দিয়ে কোর্ট এলাকায় যাওয়ার সড়কটি চলে গেছে। এই সড়কের পশ্চিম পাশে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং পূর্ব পাশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানানো হয়েছে, সেখানে রাস্তার পাশে কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেছে।
তবে স্টেশনারি দোকানের মালিক শামসুদ্দীন খান প্রথম আলোকে জানান, দুপুরে সেখানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কিংবা কারও ওপরে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি দেখেননি। কারও কাছ থেকে শোনেনওনি।
ওই দোকানের পাশে চা বিক্রেতা মো. মনিরুদ্দিন খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দিন ভইরা এই এলাকায় ব্যবসা করি। কাউরে কোপ দিছে এমন খবর শুনিনি।’
তবে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আইজি-প্রিজনস বলেন, সরকারি ডাক নিয়ে দুই কারারক্ষী মোটরসাইকেলে করে ডাকঘরে যাচ্ছিলেন। এ সময় পেছনে বসা কারারক্ষীর পিঠে ক্ষুর দিয়ে আঘাত করে এক ব্যক্তি পালিয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, কচুক্ষেতের (মিলিটারি পুলিশের ওপর হামলা) হামলার ধারাবাহিকতায় এই অপরাধ হতে পারে। তিনি বলেন, কারারক্ষীরা সরকারি পোশাক না পরে সাদা পোশাকে (সিভিলে) গেলে আক্রমণ হতো না। প্রতিষ্ঠানের বাইরে এ ধরনের কাজে গেলে সারা দেশের কারারক্ষীদের সরকারি পোশাক না পরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইজি-প্রিজনস আরও বলেন, হঠাৎ করে সরকারি পোশাক পরা (ইউনিফর্মধারী পারসন) ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ বেশি হচ্ছে। এ জন্য সারা দেশের কারাগারে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
মিলিটারি পুলিশের ওপর হামলায় মামলা হয়নি: রাজধানীর কচুক্ষেতে ঢাকা সেনানিবাসে ঢোকার প্রবেশপথে মিলিটারি পুলিশের সদস্য ল্যান্স করপোরাল সামিদুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ওই ঘটনার পরপর আটক ব্যক্তিকেও থানা হেফাজতে দেওয়া হয়নি।
তবে ঘটনার পর গতকাল দিনভর কচুক্ষেত দিয়ে সেনানিবাসে ঢোকার পথে ব্যাপক কড়াকড়ি করা হয়। প্রতিটি যানবাহন তল্লাশির পর যৌক্তিক কারণ সাপেক্ষে সেনানিবাসে ঢুকতে দেওয়া হয়। নিবিড় তল্লাশির কারণে মাঝে মাঝে যানবাহনের সারি মিরপুর ১৪ নম্বর পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।

হত্যা, হামলা
সেপ্টেম্বর ২৮
দুর্বৃত্তদের হামলায় ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা নিহত
অক্টোবর ৩
জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা
অক্টোবর ৫
পিডিবির খিজির খান হত্যা। যাজক লুক সরকারের ওপর হামলা
অক্টোবর ২২
এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা
অক্টোবর ২৩
হোসেনি দালানে হামলায় নিহত সাজ্জাদ হোসেন
অক্টোবর ৩১
প্রকাশক ফয়সল আরেফিনকে হত্যা। আরেক প্রকাশকসহ তিনজনকে হত্যার চেষ্টা
নভেম্বর ৪
দুর্বৃত্তদের হামলায় পুলিশ সদস্য মুকুল নিহত
নভেম্বর ১০
মিলিটারি পুলিশের ওপর হামলা