হুদোর মোড়ের 'হত্যার' দায় 'বুধোর ঘাড়ে'?

যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র ইসমাইল হোসেন ও তাঁর বন্ধু গ্রিল ব্যবসায়ী আল-আমিনের মৃত্যুর জট খুলছে না। তবে নিহত দুজনের পরিবারই সন্দেহের আঙুল তুলেছে কথিত ছিনতাইয়ের শিকার হতে যাওয়া বিমা কর্মকর্তা বরুণ তরফদারের দিকে।
ইসমাইলের বাবা সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট বিলাল উদ্দীন শেখ দাবি করেন, কথিত ছিনতাইয়ের শিকার বরুণ তরফদারের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব পরিষ্কার হবে।
আর আল-আমিনের চাচা ইনছার আলী বলেন, ‘ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আল-আমিন বাড়ি থেকে বের হয়। বরুণের সঙ্গে আল-আমিনের টাকাপয়সা লেনদেনের একটি সম্পর্ক ছিল বলে আমরা শুনেছি।’
তবে বরুণের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসমাইল বা আল-আমিন ওদের কাউকে আমি চিনি না।’
পুলিশ দাবি করেছে, গত ২৪ মে যশোর সদর উপজেলার হুদোর মোড়ে ছিনতাইয়ের সময় ওই দুই যুবককে জনতা পিটুনি দিলে তাঁদের মৃত্যু হয়। নিহত ইসমাইল হোসেনের মামা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন হত্যার পরপরই সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, ‘গণপিটুনি’র লেবাসে পুলিশই তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করেছে।
আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ঘটনার পর দুই যুবককে পুলিশের গাড়িতে তোলা আর তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছানোর সময়ের বড় পার্থক্যে।
তা হলে সেই রাতে হুদোর মোড়ে কী ঘটেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গত শুক্রবার যশোর-মাগুরা মহাসড়কের হুদোর মোড় এবং ২০০ গজ দূরের রাজাপুর মোড়ে গিয়ে স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। সেখানকার এক দোকানদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি, পিটুনির পর দুইজনই হেঁটে হেঁটে পুলিশের গাড়িতে উঠেছিল। এরপর শুনেছি, তারা মারা গেছে।’
হুদোর মোড়ের ছোট বাজারে সবাই সবার পরিচিত। চায়ের দোকানে গিয়ে বসলে অপরিচিত এই প্রতিবেদককে দেখে সবার চোখে কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টি ফুটে উঠল। পিটুনির ঘটনাটি কোথায় ঘটেছিল—সরাসরি এমন প্রশ্নে উপস্থিত লোকেরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। একজন বললেন, ‘সেই রাতে ঝড়-বৃষ্টি হইল। যে কারণে বাজারে লোকজন কম ছিল। আমরা বর্ষার আগেই বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। হই-হুল্লোড় শুনে রাত সোয়া ১১টার দিকে মোড়ে এসে দেখি, ১০-১২টা পুলিশের গাড়ি। এসপি সাহেবও আছেন। দুই যুবক মাটিতে বসে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে তারা নিজেরা পুলিশের গাড়িতে উঠল।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এক ব্যক্তি ও স্থানীয় আরও দুজন কৃষক যা বললেন তার সারমর্ম এই: ‘রাত ১১টার দিকে এক ব্যক্তি (বরুণ তরফদার) মোড় থেকে “ডাকাত ডাকাত” বলে চিৎকার দেন। আমরা কয়েকজন দৌড়ে যাই। গিয়ে অপর মোটরসাইকেলে থাকা দুজনকে ধরে ফেলি। তাদের টেনে মোড়ে আনা হয়। পুলিশ আসার আগেই ওদের কাছ থেকে দুটি ছুরি আর একটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। এ সময় তাদের কিলঘুষি, চড়-থাপড় দেওয়া হয়। এরপর পুলিশ এলে যেখান থেকে তাদের মোড়ে টেনে আনা হয়েছিল, সেখান থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তারা নিজেরা হেঁটে পুলিশের গাড়িতে ওঠে।’
হাসপাতালের রেজিস্টার খাতার তথ্য হলো, আল-আমিনকে ২৪ মে রাত ১টা ৫ মিনিটে এবং ইসমাইলকে রাত ১টা ৮ মিনিটে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
ঘটনাস্থল হুদোর মোড় থেকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে গাড়িতে আসতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু পুলিশ তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর। সময়ের এই পার্থক্য, অভিযুক্ত যুবকদের হেঁটে পুলিশের গাড়িতে ওঠা এবং পরে মৃত্যু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিকদার আক্কাছ আলীর দ্বারস্থ হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমত, তারা হেঁট হেঁটে গাড়িতে উঠেছে, কথাটি সত্য নয়। মূলত চার-পাঁচজনে ধরে টেনেহিঁচড়ে তাদের গাড়িতে তুলতে হয়েছে। ঘটনার আধা ঘণ্টার মধ্যে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’ ওই সময় ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এএসপিসহ (ক-সার্কেল) পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান ওসি।
কথিত ছিনতাইয়ের শিকার হতে যাওয়া বরুণ তরফদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার (২৪ মে) রাত ১০টার দিকে শহর থেকে বাড়ির পথে রওনা হই। পাঁচবাড়িয়া এলাকা পার হলে বুঝতে পারি মোটরসাইকেল পিছু নিয়েছে। কিছু দূর যাওয়ার পর মোটরসাইকেলটি শাঁ করে সামনে চলে আসে এবং হেলমেট পরা দুই আরোহী আমাকে থামতে বলে। ভয়ে মোটরসাইকেলের গতি আরও বাড়িয়ে দিই। দুর্বৃত্তদের মোটরসাইকেলের একজন চলন্ত অবস্থায় চাকু বের করে দুবার আমাকে মারতে উদ্ধত হয়। তার হাতে ঘুষি মারলে চাকু পড়ে যায়। পরে সে পিস্তল বের করে। এ সময় “ডাকাত ডাকাত” বলে আমি চিৎকার দিতে থাকি। ঠিক ওই মুহূর্তে পেছন থেকে একটি ট্রাক আসে। ট্রাকের আলো থাকায় তারা ততটা সুবিধা করতে পারেনি। তারা বারবার গুলি করার হুমকি দিতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে আমার মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে এবং দুটি মোটরসাইকেলই ছিটকে পড়ে। আবার “ডাকাত ডাকাত” বলে চিৎকার দিলে লোকজন জড়ো হয়ে তাদের ধরে পিটুনি দেয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার আর কিছু মনে নেই। অন্তত ১৫ মিনিট পরে আমার চেতন ফেরে। তখন কয়েকজন আমাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেন।’
বরুণের বাড়ি বাঘারপাড়া উপজেলার চাপাতলা গ্রামে।
নিহত ইসমাইল হোসেনের (২৩) বাড়ি সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামে। আর আল-আমিনের (২৪) বাড়ি আড়পাড়া গ্রামে। তাঁরা পরস্পর বন্ধু। ইসমাইল যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগে চতুর্থ পর্ব পর্যন্ত পড়েন। পাস না করতে পারায় সেখানেই তাঁর পড়ালেখা থেমে যায়। বছর দুই আগে যশোর শিক্ষা বোর্ড এলাকায় একটি কম্পিউটারের দোকান দিয়েছেন ইসমাইল।
ইসমাইলের বাবা বিলাল উদ্দীন শেখ যশোর সেনানিবাসে সার্জেন্ট পদে কর্মরত আছেন। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, আল-আমিনের সঙ্গে বরুণ তরফদারের যোগাযোগ ছিল। ঘটনার দিন বরুণ ফোন করে আল-আমিনকে হাইকোর্ট মোড়ে আসতে বলে। আল-আমিন ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে হুদা রাজাপুর এলাকায় যায়। সেখানে নিয়ে বরুণ চলন্ত অবস্থায় কৌশলে মোটরসাইকেল থেকে তাদের ফেলে দিয়ে “ডাকাত ডাকাত” বলে চিৎকার দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বরুণসহ দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর কী করে তারা মারা গেল, আমরা বুঝতে পারছি না।’ তিনি দাবি করেন, ‘বরুণের মুঠোফোন পরীক্ষা করলেই হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোতোয়ালি থানার ওসি সিকদার আক্কাছ আলী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরুণের সঙ্গে আল-আমিনের যোগাযোগের বিষয়ে আমরা এখনো কিছু জানতে পারিনি। আর মোবাইল ফোনের কথা যেহেতু উঠেছে, আমরা তিনজনের কললিস্টই যাচাই করে দেখব।’
গতকাল বেলা ১১টার দিকে যশোর শহরের শেখহাটি জামরুলতলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ইসমাইলের কম্পিউটারের দোকান ‘সিদ্দিক কসমেটিকস অ্যান্ড স্টুডিও’ বন্ধ। পাশের এক মুদি দোকানি জানান, হত্যার পর থেকে ইসমাইলের দোকান বন্ধ রয়েছে।
দোকানটির মালিক গোলাম হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল না। তাঁর স্ত্রী জানান, দুই বছর আগে ইসমাইল দোকানঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ইসমাইলের আচার-ব্যবহার খারাপ ছিল না। মোটামুটি ভালো ছেলে হিসেবেই আমরা তাঁকে জানতাম। সিদ্দিক নামে আরেকজন আছেন ইসমাইলের অংশীদার।’
ইসমাইলের দোকানের অংশীদার নূর আলম সিদ্দিকের বাড়ি ইসমাইলের বাড়ির পাশেই। তিনি শহরের মনিহার ফলপট্টিতে এক আড়তে চাকরি করেন। একটি কম্পিউটার দিয়ে দোকানের অংশীদার হয়েছেন। ইসমাইলই দোকানটি চালাতেন। মাঝেমধ্যে তিনি খোঁজখবর নিতেন।
নূর আলম সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে ইসমাইল দোকান খুলেছিল। দুপুরে বাড়িতে খেতে যায়। ওই দিন আর দোকান খোলেনি। তবে বিকেলে বাজারে চায়ের দোকানে তাকে অনেকে দেখেছিল।’
আর শহরের খাজুরা স্ট্যান্ড এলাকায় আরেকজনের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে গ্রিল তৈরির দোকান (ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপ) দিয়েছিলেন আল-আমিন। সম্প্রতি তিনি তাঁর অংশটি ছেড়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি পুরোনো মোটরসাইকেল বেচে একটি নতুন মোটরসাইকেল কেনেন বলে জানা গেছে।
আল-আমিনের বাবা আগেই মারা গেছেন। ভাই রবিউল ইসলাম দেয়ালে রঙের কাজ করেন। মা গৃহিণী। আল-আমিন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে গ্রিলের কাজ শুরু করেন। ইসমাইল ছিলেন তাঁর বন্ধু। ইসমাইলের দোকানেই আল-আমিনের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত।
দুজনের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন যশোর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক আবদুর রহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুরতহালে দেখা গেছে, দুটি লাশেরই মাথায় গুরুতর জখম। মাথার বিভিন্ন স্থানে তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা কয়েকটি ফাটা জখম। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোলা ফোলা আঘাতের চিহ্ন ছিল।’
নিহত যুবক ইসমাইলের মামা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গণপিটুনিতে নিহত হলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাতের চিহ্ন থাকত। কিন্তু মাথা ছাড়া তাদের শরীরের আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না।’ তিনি দাবি করেন, ‘নিহত দুজনের কারও বিরুদ্ধেই থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগ নেই। যে কারণে পুলিশ তাদের “ক্রসফায়ার” দিতে পারেনি। তবে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে গণপিটুনি বলে চালানোর অপচেষ্টা করছে।’
লাশের ময়নাতদন্তকারী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক কাজল মল্লিক বলেন, ‘ময়নাতদন্তের কাজ শেষ। তবে প্রতিবেদন এখনো দেওয়া হয়নি। দু-এক দিনের মধ্যে দেওয়া হবে। এর আগে মন্তব্য করা যাবে না। তবে আঘাতজনিত কারণে দুজনের মৃত্যু হয়েছে, এটুকু বলা যায়।’
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক বলেন, ‘গণপিটুনির সময় এলাকার শত শত লোক বলেছে “ওরা ডাকাত”। মোটরসাইকেলের নেমপ্লেট বদলানোর জন্য ওদের পকেটে যন্ত্রও পাওয়া গেছে। অস্ত্র পাওয়া গেছে। এলাকার লোকজন পিটুনি দিয়ে গুরুতর অবস্থায় হাত-পা ধরে ওদের পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়।’
কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তাঁরা হেঁটে পুলিশের গাড়িতে উঠেছেন—এমন তথ্যের জবাবে কে এম আরিফুল হক বলেন, ‘গণপিটুনির ঘটনায় একটা মামলা হয়েছে। ওই মামলার ভয়ে সম্ভবত এলাকার লোকজন এখন অন্য কথা বলতে পারেন।’