হেলমেট পরা অস্ত্রধারীসহ ছাত্রলীগের ছয়জন শনাক্ত

কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হেলমেটধারী সেই তরুণ অবশেষে শনাক্ত।

শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে নাহিদ হোসেনকে কোপাতে দেখা যায়। গত মঙ্গলবার দুপুরে।
ছবি: ডেইলি স্টার

বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করতে দেখা গিয়েছিল হেলমেটধারী এক তরুণকে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর নাম বাশার ইমন। তিনি ঢাকা কলেজের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র ইমন ক্যম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

ইমনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনী। তাঁর খোঁজে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে অভিযান চালানো হয়েছিল। তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে চাইছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

এদিকে নিউমার্কেট এলাকায় গত মঙ্গলবার সংঘর্ষের ঘটনায় ইমন ছাড়াও হেলমেটধারী আরেকজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। তাঁর নাম শাহাদাৎ হোসেন। সেদিন স্টিলের পাইপ হাতে হামলা ও সংঘর্ষে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। শাহাদাৎ ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী। কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের আবাসিক এই শিক্ষার্থীর বাড়ি নেত্রকোনায়। তিনি স্নাতক (সম্মান) অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। শাহাদাৎ ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসীম উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

অন্যদিকে ধারালো অস্ত্র হাতে নাহিদকে কোপানো বাশার ইমন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ ওরফে জুলফিকারের অনুসারী।

বাশার ইমন

এ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ছয়জনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। তাঁরা সবাই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের নেতা–কর্মী। ইমন ও শাহাদাৎ ছাড়া বাকি চারজন হলেন কাইয়ুম, সুজন সরকার, শাহীন সাদেক মীর্জা ও কাউসার হামিদ ওরফে সাদা কাউসার। এর মধ্যে শাহীন কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত হওয়া আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। এই ছয়জনের মধ্যে কাইয়ুম, সুজন ও ইমন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত। ঘটনার বিভিন্ন ফুটেজ বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য এবং গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেটের সংঘর্ষের ঘটনায় ধারালো অস্ত্রধারী ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং দুজনকে হত্যার ঘটনায় আরও যাঁরা জড়িত, তাঁদের সবাইকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

এদিকে গতকাল পরিচয় শনাক্ত করার পর হেলমেটধারী ইমন এবং শাহাদাতের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো।

ইমনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আর শাহাদাতের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এক নারী অপর প্রান্ত থেকে বলেন, এটি শাহাদাতের মুঠোফোন নম্বর নয়। পরক্ষণেই তিনি কলটি কেটে দেন।

কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে অভিযান

ঢাকা কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ১০১ নম্বর কক্ষ থেকে জহির হাসান নামের এক শিক্ষার্থীকে গতকাল সন্ধ্যায় আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই কক্ষে বাশার ইমন থাকতেন। অবশ্য অভিযানের সময় তাঁকে পাওয়া যায়নি।

এর আগে গতকাল ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের এলাকা থেকে চারজনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থাই বিষয়টি স্বীকার করেনি। অবশ্য শিক্ষার্থীরা চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও দুজনের বিষয়ে তথ্য দিতে পেরেছেন। তাঁরা হলেন ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ ওরফে জুলফিকার ও মো. জসীম উদ্দিন। দুজনই মঙ্গলবারের সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন। সামাদ ও জসীম দুজনই ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আগামী কমিটিতে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী। সামাদের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায় আর জসীমের নেত্রকোনায়।

সংঘর্ষের সময় কলেজের যে চারজন ছাত্রলীগ নেতার অনুসারীরা ধারালো অস্ত্র হাতে বেশি বেপরোয়া ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই দুই নেতাও রয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।

জসীম উদ্দিনের সঙ্গে গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। তবে রিং হলেও ফোন ধরেননি তিনি। তাঁর সঙ্গে গত শনিবার কথা হয় প্রথম আলোর। সেদিন তিনি বলেছিলেন, মঙ্গলবারের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

অন্যদিকে সামাদ আজাদের মুঠোফোন গতকাল বন্ধ পাওয়া যায়। শনিবার তিনি বলেছিলেন, সংঘর্ষের সময় ছাত্রদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। নিউমার্কেটের দুটি খাবারের দোকানের দুই কর্মীর বিতণ্ডা থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত। এর জের ধরে ১৯ এপ্রিল (গত মঙ্গলবার) দিনভর রাজধানীর মিরপুর সড়কের নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন বিপণিবিতানের দোকানমালিক-কর্মচারী ও হকারদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে মারা গেছেন দুজন (কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেন ও দোকানকর্মী মোহাম্মদ মোরসালিন)। আহত হয়েছেন অর্ধশত ব্যক্তি।

গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র বলেছে, সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে এবং ধারালো অস্ত্র হাতে শুধু ছাত্ররা নয়, ব্যবসায়ী-দোকানকর্মী ও হকাররাও অংশ নেন। তাঁদের শনাক্ত করা হচ্ছে।

নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা দুটি। আর চার মামলায় মোট আসামি ১ হাজার ৫৭৪ জন। এর মধ্যে নাম উল্লেখ করা আসামি ২৪ জন, অন্যরা অজ্ঞাতপরিচয়।

সংঘর্ষের ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় মকবুল হোসেনকে। এই মামলায় নাম উল্লেখ করে মকবুলসহ যে ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের সবাই নিউমার্কেট এলাকার বিএনপির নেতা-কর্মী। তবে আসামিদের মধ্যে মকবুল ছাড়া আর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবারের ঘটনায় হওয়া দুটি হত্যা মামলার তদন্ত করছে ডিবি। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

তাঁদের আসামি করা হয়নি

১৮ এপ্রিল রাতে ঘটনার সূত্রপাত ঢাকার নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেটের দুটি খাবারের দোকানের কর্মী কাউছার ও বাপ্পীর বাগ্‌বিতণ্ডা থেকে। পরে বাপ্পী ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে নিয়ে এসে কাউছারের ওপর হামলা করেন। কাউছারের লোকজন তাঁদের ওপর পাল্টা হামলা করে সেখান থেকে বের করে দেন।

পুলিশ, ব্যবসায়ী ও ছাত্রলীগ সূত্র বলছে, ১৮ এপিল রাতে হামলা চালাতে গিয়ে নাসিম ও লিটন নামের ছাত্রলীগের দুই কর্মী প্রথমে আহত হন। অপর ছাত্রলীগের কর্মী আবদুল্লাহ আল মাসউদ ধাওয়ার মুখে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে গুজব ছড়ান, খাবারের বিল পরিশোধ করা নিয়ে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে দোকানকর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা করছেন। এতে অন্য ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে কিছু ছাত্র নিউমার্কেটে হামলা চালাতে গেলে স্থানীয় ব্যবসায়ী–দোকানকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ওই রাতে পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেও পরদিন সকাল থেকে আবার উত্তজনা ছড়িয়ে পড়ে। দিনভর সংঘর্ষ–ভাঙচুর, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

পুলিশের করা দুটি মামলার এজাহারে ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে, সেটি উল্লেখ নেই। দুই দোকানকর্মী এবং হামলা চালাতে যাওয়া ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে আসামি করা হয়নি। এই পাঁচজনের অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যখন মামলা করা হয়েছিল, তখন ঘটনার সূত্রপাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য ছিল না। ভিডিও ফুটেজ এবং অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ করে দুই দোকানকর্মী ও ঢাকা কলেজের তিন ছাত্রের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। যেহেতু তাঁরা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা মামলার আসামি হবেন। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।