'একটা মা, তার কত লাগে গো?'
`বুঝলাম, মা না হয় খারাপ। কিন্তু তোমার পিছে পিছে ঘুরছিল কে? বড় করেছে কে? মানুষ পরীক্ষা দিলে একটা নম্বর পায়, আমি পরীক্ষা দিয়া তো পাইলাম জিরো। ঈদের একটা দিন, শাক রাইন্ধ্যা খাইলাম।'
সন্তানদের সম্পর্কে কথাগুলো পঞ্চাশোর্ধ্ব রেজিয়া ইসলামের। দুই ছেলে আর দুই মেয়ের মা তিনি। আছেন স্বামীও।
দুই মেয়েকে এম এ পাস করিয়ে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। রাজধানীতে মিরপুরে আছে চার তলা একটি বাড়ি। আর কুমিল্লায় একতলা দুইটি বাড়ি। এত কিছু থেকেও তাঁর এখন কিছুই নেই। একই বাড়িতে বসবাস করলেও স্বামী ও ছেলেরা তাঁকে খেতে দিচ্ছেন না। মেয়েরা দূরে থাকেন। স্বামীর জন্য তাঁরাও কিছু করতে পারেন না বলে অভিযোগ তাঁর।
স্বামী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে ২৮ জুন জিডি করেছেন মিরপুর মডেল থানায়। স্বামী ও ছেলেরা খাবার দিচ্ছে না বলে নালিশ করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাছেও। এ নিয়ে সালিসি বৈঠকে মুচলেকা দিয়েও কথা রাখেননি তাজুল ইসলাম। বরং কিছু চাইলে বাবা ও ছেলেরা মহিলা পরিষদের কাছে গিয়ে চাইতে বলেন।
স্বামী-সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে রেজিয়া ইসলাম বলেন, ‘পেটে ভাত না থাকলে মানসম্মান দিয়ে কী হবে? দেওয়ালে এখন পিঠ ঠেকে গেছে।’
এক বছরের বেশি সময় ধরে মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে আর বাড়ির ছাদে লাগানো শাক পাতা দিয়ে চলছে তাঁর খাবার। একই বাড়িতে দুই ফ্ল্যাটের একটিতে একা থাকেন রেজিয়া ইসলাম। আরেক ফ্ল্যাটে তাঁর স্বামী, এক ছেলে ও ছেলের বউ থাকেন। অন্য ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া।
৭০ বছর বয়সী (রেজিয়া ইসলামে দাবি) স্বামী তাজুল ইসলামও তাঁর স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তবে বলছেন, ‘খাবার না দেবার পেছনে অসংখ্য যুক্তি আছে।’ নিজে স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না এবং বাজার করে না দিলেও তাঁর (স্ত্রীর) কাছে অনেক টাকা আছে বলে দাবি করলেন তাজুল ইসলাম।
রেজিয়া ইসলাম কার বিরুদ্ধে কথা বলবেন? একদিকে স্বামী, আরেক দিকে তাঁরই নাড়ি ছেঁড়া ধন। তাইতো প্রথম আলোর এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। বললেন স্বামীর দীর্ঘ ১৯ বছর বিদেশ থাকার সময় ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার কথা।
‘বড় ছেলের পড়াশোনার জন্য ঢাকা, কুমিল্লাসহ যেখানে যেখানে যেতে হয়েছে দৌড়ে বেড়িয়েছি। স্বামী বিদেশ থাকলেও কখনোই আমার নামে টাকা পাঠাতেন না। পাঠাতেন নিজের ভাইয়ের কাছে। নিজের সংসারের চেয়ে নিজের ভাই আর বোনসহ অন্যদের পেছনেই বেশি ব্যয় করেছেন।’
জানালেন, শেষ মুহূর্তে নিজের যেটুকু গয়না ছিল তা বিক্রি করে এক রকম জেদ করেই মিরপুরের বাড়িটি কিনতে বাধ্য করেন তিনি। এই বাড়ি কেনার জন্য বিয়ের মোহরানা বাবদ স্বামীর দেওয়া জমিটুকুও বিক্রি করে দেন। এখন পর্যন্ত থাকার মধ্যে শুধু আছে মিরপুরে আহমেদ নগরের বাড়িটাতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই।
রেজিয়া ইসলামের সঙ্গে যখন কথা হয়, তাঁর দুই হাতে চিকন দুইটি ইমিটেশনের রং উঠে যাওয়া চুড়ি। নাকে নাক ফুল পর্যন্ত নেই। গায়ের পোশাকও মলিন। সকালে কাঁঠালের দুইটি কোষ খেয়েছেন। দুপুরে এক আত্মীয় ভাত খাইয়েছিলেন। জানালেন রাতে চাল ফুটিয়ে ভাত আর শাক খাবেন।
রেজিয়া ইসলাম নিজেও ভেবে পান না তাঁর অপরাধটা কোথায়। একদম ছোট বয়সে বিয়ে। স্বামীর বয়স তাঁর চেয়ে অনেক বেশি।
রেজিয়া ইসলাম দেশে স্বামী না থাকা অবস্থায় প্রায় ১৯ থেকে ২০ বছরের কথা ভুলতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘এক বা দুই বছর না। ২০টা বছর। আমার নতুন জীবন শেষ করলাম।” তিনি বলেন, ‘আমার ঘরের চুলা খুইল্যা নিয়া যায়। টেলিভিশনের তার খুইল্যা নিয়া গেছে। ছাদে শাকপাতা লাগাইছি, তা যাতে খাইতে না পারি তার লেইগ্যা ছাদে তালা দেয়। বাপের অনেক সম্পত্তি। তাই বাপের পিছু নিছে ছেলেরা। আর এখন আমি হইছি খারাপ।’
রেজিয়া ইসলাম জানান, তাঁর সঙ্গে স্বামী এবং ছেলেদের সম্পর্কের কারণে মেয়েরাও শ্বশুর বাড়িতে কথা শুনছে। রমজানের পুরো মাস রেজিয়া ইফতার করেছেন পানি আর মুড়ি খেয়ে। রাতের বেলাও আটার রুটি খেয়েছেন প্রায় সময়। স্বামী-সন্তানের অবহেলায় ভাড়াটিয়ারা পর্যন্ত রেজিয়া ইসলামের গায়ে হাত তোলার সাহস পায়।
রেজিয়া ইসলাম জানালেন, চারতলা বাড়ির নিচ তলায় দারোয়ানের থাকার জন্য ছোট একটি ঘর আছে। তার ভাড়া পাওয়া যায় ১৫শ টাকা। এই টাকায় স্বামী ও ছেলেরা এখন পর্যন্ত হাত দেয়নি। কিন্তু ১৫শ টাকায় কী আর মাস যায়? ইনসুলিন কেনার টাকা থাকে না প্রায়ই।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আহমেদ নগর পাইকপাড়া কমিটির সভাপতি হুমায়রা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেজিয়া ইসলামের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর ১ জুলাই সালিস ডাকা হয়। রেজিয়া ইসলামের দোষ যে কি তা ছেলে বা ছেলের বাবা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। শুধু বলে, “খারাপ। চিৎকার চেঁচামেচি করে।” কিন্তু এই অভিযোগে একজন মানুষকে দিনের পর দিন খাবার দেওয়া হবে না তা তো হতে পারে না। রেজিয়া ইসলামের স্বামী লিখিত মুচলেকা দিয়ে যান। তারপর দুই দিন খাবার দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন এই অভিযোগ পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হবে।’
রেজিয়া ইসলামের স্বামী তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওকে কেন খাবার দেওয়া হয় না তা ওর কাছেই জানতে চান। ওর অত্যাচারে তিতা হইতে হইতে এখন খাবার বন্ধ কইরা দিছি। ওর অভিযোগ সত্য। তবে অভিযোগের পিছনে কারণও আছে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে কেউ ওরে পছন্দ করে না। ও খুব অসৎ। ওর কারণেই আমার সংসার তছনছ হইয়্যা গেছে। মহিলা পরিষদ ওর মধ্যেই দোষ খুইজ্যা পাইছে। তারপরও কইছে খাবার দিতে। দুই দিন খাবার দেবার পর আর দিতে ইচ্ছা হয় নাই। চুলা খুইল্যা আনছিলাম, আবার লাগায়া দিছি। কইছি, বাজার কইরা কেমনে খাবি খা।’
তাজুল ইসলাম জানালেন, স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না, বাজার করে দেন না-সবই সত্য। তবে না খেয়ে থাকে না। ছাদে শাক পাতা আছে। দারোয়ানের ঘর ভাড়া বাবদ ২৫শ (রেজিয়া ইসলাম বলেছেন ১৫শ টাকা) টাকা পান। আগেও এ ঘরের ভাড়া তিনিই নিতেন, তা জমিয়ে এখন অনেক টাকা হয়েছে। স্ত্রীর কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা আছে বলেও তাঁর দাবি।