'দে আর ভেরি প্রফেশনাল'

বন্ধ একটি কক্ষে দীর্ঘ ৮১ দিন আটক ছিলেন ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়। সেখানে জিনিসপত্র বলতে শুধু একটি খাট ও বিছানাপত্র ছিল। লাগোয়া ছিল একটি টয়লেট। কক্ষটিতে কোনো জানালা ছিল না। ছিল না বাইরের আলো ঢোকার কোনো পথ। শুধু টয়লেটের ওপরে ছিল ভেন্টিলেশনের একটা ছোট্ট পথ। সেখান দিয়েও অবশ্য বাইরে আলো আছে কি নেই, সেটা বোঝা যেত না।

অনিরুদ্ধ রায়ের ভাষায়, ‘যে গ্রুপটা এই কাজটা করেছে, দে আর ভেরি প্রফেশনাল (তারা খুবই পেশাদার)। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। প্রফেশনাল ছাড়া এত সুন্দর অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্ভব না। একেবারে স্পেশালাইজড অ্যারেঞ্জমেন্ট। আমার জন্যই টোটাল অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল। ৮১ দিনই এখানে। বাইরে বের হতে দেয়নি। খাবার সময় খাবার দিয়ে যেত। ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসত। দরজা বাইরের দিক থেকে ছিটকিনি লাগানো।’

গত ২৭ আগস্ট গুলশান ১-এর ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে মিটিং শেষে বের হওয়ার পর একটি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের সাতবার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব (সিআইপি) ও বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায়কে। এরপর রহস্যজনকভাবে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে তিনি তাঁর গুলশান ১ এর বাসায় ফেরেন।

শুক্র ও শনিবার দুই দিন তিনি বা তাঁর পরিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। রোববার সকালে গণমাধ্যমে পাঠানো একটি চিঠিতে ব্যবসায়িক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন অনিরুদ্ধ রায়। পুরো ঘটনার জন্য তিনি তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদকে দায়ী করেন। তবে গতকাল পর্যন্ত তিনি ওই অংশীদারের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেননি।

 যোগাযোগ করা হলে অভিযোগের বিষয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে প্রচণ্ড আহত ও দুঃখিত হয়েছেন। অনিরুদ্ধ যেসব অভিযোগ করেছেন তা পুরোটাই অসত্য। এ ঘটনা তাঁকে সামাজিকভাবে প্রচণ্ড হেয়প্রতিপন্ন করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওই পাঁচটি অভিযোগের সব কটিই যে অসত্য, তার তথ্য-প্রমাণ তাঁর কাছে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। চিঠিতে তাঁকে অপহরণের জন্য দায়ী করলেও গতকাল পর্যন্ত মহিউদ্দীনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেননি অনিরুদ্ধ। এ বিষয়ে মহিউদ্দীন বলেন, ‘বিষয়টি তো ভাই অসত্য। আমি আমার লোকজনের সঙ্গে আইনি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’

নিখোঁজ হওয়া থেকে শুরু করে পুরো ঘটনা নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় অনিরুদ্ধের বাসায় তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। অনিরুদ্ধের বাসায় যখন এই প্রতিবেদক যান, তখন নিরাপত্তাকর্মীরা প্রথমে জানিয়ে দেন, তিনি বাসায় নেই। পরে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ‘পাঁচ মিনিট’ অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর তাঁর দেহরক্ষী নিচে নেমে আসেন। তিনি এই প্রতিবেদককে সঙ্গে করে অনিরুদ্ধের ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। ফ্ল্যাটের বসার ঘরে একটি সোফায় বসে মুঠোফোনে তখন কথা বলছিলেন অনিরুদ্ধ।

মুঠোফোনে কথা বলা শেষ হওয়ার পর তিনি কথা বলা শুরু করেন। কথা প্রসঙ্গে ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনিরুদ্ধ বলেন, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে তিনি যখন বের হলেন, তখন সামনে থেকে এসে একটা লোক তাঁকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি অনিরুদ্ধ রায়? আপনি কি বেলারুশের অনারারি কনসাল?’

তিনি বলেন, ‘অমুক-তমুক বলতে বলতে যখন আগাচ্ছি, তখন হঠাৎ আরেক লোক এসে ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলল। তারপর বলল নিচ দিকে তাকায় থাকো। ওরা আমারে এমনভাবে বসায়া রাখল যে কোনো সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড় করালেও যেন বুঝতে পারে, একটা নরমাল লোক বসে আছে। তাদের নির্দেশনা ছিল—আপনি আমাদের দিকে তাকাবেন না, ওপরের দিকে তাকাবেন না। তাকালে আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে। পুরা থ্রেটের ওপর।’

গাড়ি কতক্ষণ চলল এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই দিন সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে সোনারগাঁও হোটেলে ব্যায়াম করতে যাই। এরপর সচিবালয়ে গিয়ে একটি বৈঠক করি। সেখান থেকে ইউনিয়ন ব্যাংকে বৈঠক শেষ করে বাসায় এসে খাওয়ার কথা ছিল। সারা দিন না খাওয়া। ব্রেনের নার্ভটা ঠিকমতো কাজ করছিল না। সেন্স ছিল কি ছিল না, এর মাঝামাঝি অবস্থা। আমি চিন্তা করলাম, আমি তো জীবনে কোনো অপরাধ করিনি। আমার বিরুদ্ধে কোনো জিডিও নাই। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত না। কী কারণে আমাকে নিয়ে যাবে। মাথা কাজ করছিল না। মৃত্যুর কাছাকাছি যখন আপনি চলে যান, তখন তো আপনার মাথা কাজ করবে না।’ তিনি বলেন, ‘মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। আমি যে কিছু একটা আন্দাজ করব, সেই সময়ও পাই নাই। আমার ড্রাইভারও কোনো চিৎকার দেয়নি।’

অনিরুদ্ধ রায় জানান, সাড়ে চারটায় গাড়িতে তোলার পর বেশ অনেকক্ষণ গাড়িটি তাঁকে নিয়ে ঘুরেছে। যখন গাড়ি থেকে নামানো হয় তখন অন্ধকার। দুই দিক থেকে দুজন তাঁর দুই কাঁধ ধরে হাঁটতে বলে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বুঝতে পারেন, একটি দোতলা ঘর হবে। যে কক্ষে তাঁকে নিয়ে যায়, সেটা সাধারণ একটা অ্যাপার্টমেন্টের কক্ষের মতো।

কক্ষের জিনিসপত্রের বর্ণনা জানতে চাইলে অনিরুদ্ধ রায় বলেন, ‘খাটটি কাঠের, সিঙ্গেল খাট। সাধারণ যে বাড়ির খাট, ওরকম। জাজিম-টাজিম যা যা দরকার তা তা ছিল। সবকিছু গোছানো ছিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।...খাবারের সময় খাবার দিয়ে যেত। দরজা বাইরের দিক থেকে ছিটকিনি লাগানো। ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসত।’

একই ব্যক্তিই কি খাবার দিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে ব্যক্তির বদল হতো। জিজ্ঞেস করত, আপনি চিন্তা কী করলেন। ট্রের মধ্যে শুধু খাবার থাকত। খাবার ভালো ছিল। ভাত, তরকারি, মাছ, মাংস ভাজি, ডাল—এসবই দিত। সকালে নাশতা, পরোটা ভাজি। মাঝে মাঝে খিচুড়িও দিত।’

* অনিরুদ্ধ রায় দেশের সাতবার সিআইপি ও বেলারুশের অনারারি কনসাল

* গত ২৭ আগস্ট গুলশান থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়

* ৮১ দিন পর ঘরে ফেরেন

অনিরুদ্ধ রায় বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেও তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। শেষ রাতের দিকে তাঁকে ডেকে তোলা হয়। বলল, ‘চলেন, আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসি। বললাম, মাইরাটাইরা ফেলবেন না তো? বলে, না, আপনারে মাইরা লাভ কী। আপনি কোনো কথা শোনেন না। এসব ব্যাপারে কোনো কিছু ঘাঁটাঘাঁটি কইরেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে ভাই, আমাকে নামায়া দেন। আমার ফ্যামিলির কাছে যাই।’ এরপর একটি মাইক্রোবাসে করে তাঁকে তাঁর বাসার কাছের চার রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা। তিনি সেখান থেকে হেঁটে বাসায় ঢোকেন। তখন রাত সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা বাজে।

অনিরুদ্ধ বলছিলেন, প্রতিটি অপরাধের পেছনে একটা লাভবান পক্ষ থাকে। তাঁকে আটকে রাখার কারণে লাভবান হয়েছে তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার। তা ছাড়া আটক থাকাকালীন যারা খাবার দিতে আসত, তারাও তাঁকে ব্যবসা নিয়ে, অংশীদারত্ব নিয়ে কী ভাবলেন, তাই জিজ্ঞেস করতেন।

অনিরুদ্ধ রায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, শুক্রবার ট্রেডমিলে হাঁটতে গিয়ে তাঁর ‘কাফ মাসলে’ টান লেগেছে। ডাক্তার তাঁকে বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। এ জন্য কোথাও যেতেও পারছেন না।

পুরো আলাপনে অনিরুদ্ধ তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং যেখানে রেখেছিল, সেই জায়গা নিয়ে কথা বলতে বারবার ইতস্তত করছিলেন। ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে গোলমালের বিষয়টাই টানছিলেন বারবার। অনিরুদ্ধ বললেন, ‘আমি চেষ্টা করব পিএম-এর সঙ্গে দেখা করার। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান কী করা যায়, সেটা নিয়ে কথা বলব। মাইনরিটি হিসেবে আই ওয়ান্ট জাস্টিস ফ্রম হার।’

এর আগে গতকাল সকালে গণমাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে অনিরুদ্ধ রায় বলেন, ‘আমি অনিরুদ্ধ কুমার রায়, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), আরএমএম গ্রুপ। আমি ব্যবসায়িক প্রতিহিংসার শিকার। আমার ব্যবসায়িক অংশীদার মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন গং আমার প্রতিষ্ঠিত তিনটি প্রতিষ্ঠান আরএমএম লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আরএমএম নিট ক্লথিং লিমিটেড ও আরএমএম সোয়েটার লিমিটেড (যার সম্পদের মূল্য ১৫০ কোটি টাকার অধিক) হস্তগত করার জন্য হেন কোনো কাজ নেই, যা করেননি। ২৭ আগস্ট গুলশান ১-এর ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে মিটিং শেষে ফেরার পথে বিকেল সাড়ে চারটায় ওই বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে আমাকে অপহরণ করা হয়। সম্ভবত ব্যবসায়িক প্রতিহিংসার কারণে এমনটা হয়েছে বলে আমি আশঙ্কা প্রকাশ করি।’

গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিঠিটি গণমাধ্যমে দেখলাম। তবে তিনি পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ করেননি, এমনকি ওই চিঠির কপিও পুলিশকে দেননি। এমনকি গত তিন দিনে তাঁর সঙ্গে কথাও বলতে পারেনি পুলিশ।’