'সুদখোরে'রা বেপরোয়া
বার্ষিক সুদ ২৪০ থেকে ৩০০ শতাংশ! হ্যাঁ, এই হারেই সুদ আদায় করছেন অবৈধ সুদের কারবারিরা। ঋণগ্রহীতা টাকা দিতে ব্যর্থ হলে শুরু হয় নানা অত্যাচার। এই চিত্র রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী বাজারের। ‘সুদখোর’দের উৎপাতে গত দু্ই বছরে সেখানকার সাতজন ব্যসায়ী নিরুদ্দেশ হন।
জনপ্রতিনিধিরা সুদের ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। আড়ানী পৌরসভার মেয়র মোক্তার আলী গত মঙ্গলবার রাতে বলেন, ‘এই এলাকায় সুদের কারবারিরা বেপরোয়া। তাঁদের সামাজিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে ভুক্তভোগীদের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।’
এই প্রতিবেদক গত ২০ সেপ্টেম্বর আড়ানী বাজারে যান। সেদিন এ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, আড়ানী এলাকায় শতাধিক মানুষ সুদের ব্যবসায় জড়িত। তাঁরা এক লাখ টাকার বিপরীতে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা সুদ আদায় করেন। জামানত হিসেবে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ফাঁকা চেক নেন। ১০ লাখ টাকার দাবিতে ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে বাজারের শাহমখদুম বিপণিবিতানের রাকিব বস্ত্রালয়ে ছয়টি তালা দেন এক সুদখোর। পরে দোকান মালিক বাঘা থানায় অভিযোগ দিলে পুলিশ এসে তালা ভাঙে।
জানতে চাইলে দোকান মালিক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগে তিনি একই উপজেলার গোচর গ্রামের ইউসুফ আলীর কাছ থেকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকার বিপরীতে ২০ হাজার টাকা সুদ দেওয়ার চুক্তিতে ৮৩ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা শোধ করেছেন। কিন্তু ইউসুফ আরও ১০ লাখ টাকা চাচ্ছেন। রফিকুল আরও বলেন, জামানত হিসেবে তিনি ইউসুফকে দুটি ফাঁকা চেক দিয়েছিলেন। এখন শুনতে পাচ্ছেন, ওই চেক দুটিতে মোটা অঙ্ক বসানো হয়েছে।
জানতে চাইলে ইউসুফ আলী বলেন, ১০ লাখ নয়, রফিকুলকে তিনি চার লাখ টাকা ধার দিয়েছিলেন। বারবার তারিখ দিয়েও ওই টাকা শোধ করেননি রফিকুল। এ কারণে তাঁর দোকানে তালা দিয়েছিলেন। চেক জামানত নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, শুধু আড়ানীতে নয়, সারা দেশেই চেক নেওয়া হয়।
আড়ানী পালপাড়ার বাসিন্দা পশুচিকিৎসক রুহুল আমিনের ওষুধের দোকান আছে আড়ানী বাজারে। তিনি মাস খানেক আগে স্ত্রী-সন্তানকে বাবার সংসারে রেখে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ফিরে এসেছেন। পরদিন তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সুদের কারবারিদের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা হয়েছে। এ কারণে রুহুল বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছেন।
রুহুলকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর বাবা আবদুস সামাদ ছেলের দোকানে বসা ছিলেন। আবদুস সামাদ বলেন, তাঁর ছেলের সুদের টাকা পরিশোধের জন্য তিনি ২০ লাখ টাকার বেশি দিয়েছেন। তবু এই সুদের টাকা শোধ হয় না। বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন।
শ্যামল কর্মকারের বাড়ি আড়ানী বাজারেই। বাড়ির সঙ্গেই রয়েছে তাঁর সোনার দোকান। তাঁর ছেলে গণেশ কর্মকার বছর দুই আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিরুদ্দেশ হন। এ বিষয়ে শ্যামল কর্মকার বলেন, ছেলের কাছে নাকি ওঁরা (সুদের ব্যবসায়ী) ৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা পাবেন। এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। তারপরও তাঁর (শ্যামল কর্মকার) বিরুদ্ধে সুদের কারবারিরা মামলা করেছিলেন। তিনি এই মামলা থেকে গত জানুয়ারিতে অব্যাহতি পান।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, আড়ানী বাজারের শান্তি সুপার মার্কেটে বসু হালদারের মুদির দোকান ছিল। সুদের টাকা শোধ করতে না পেরে বছর খানেক আগে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতের বেলায় পালিয়ে যান। একই মার্কেটে জুতার দোকান ছিল বিবেক শীলের। তিনিও সুদের টাকা শোধ করতে না পেরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
আড়ানী বাজারের গোরস্থান বিপণিবিতানে দোকান ছিল রিপন সরকারের। তিনি চিনির ব্যবসা করতেন। ঋণের বোঝা নিয়ে প্রায় এক বছর আগে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরুদ্দেশ হন। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন আড়ানী এলাকার আকবর আলী ও রানা চন্দ্র। এ ছাড়া বাজারের অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বলেন, তিনি বাড়িঘর বিক্রি করে ঋণের টাকা শোধ করেছেন। এখন সেই বাড়িতেই ভাড়ায় থাকেন।
রফিকুলের দোকানের তালা খুলে দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী মাহমুদ বলেন, যাঁরা তালা লাগিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরা নিজেরাই মিটমাট করেন। এ কারণে আর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হামিদুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগীরা তার কাছে অভিযোগ দিলে তিনি বিষয়টি তদন্ত করাতে পারেন। তদন্তে প্রমাণিত হলে সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।