‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হত্যা নিয়ে একেকবার একেক তথ্য দিচ্ছেন শিমুল’

  • আক্তারুজ্জামান নেপাল থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে।

  • আরেক আসামি সিয়াম হোসেন নেপালে।

  • পলাতক অপর দুজন দেশে আছেন।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবে পুলিশ যাঁকে শনাক্ত করেছে, সেই শিমুল ভূঁইয়া রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বিভ্রান্তির তথ্য দিচ্ছেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, খুলনা অঞ্চলের পেশাদার খুনি ও সাবেক চরমপন্থী নেতা শিমুল যে আনোয়ারুল হত্যায় সরাসরি জড়িত, তা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসাবাদে আনোয়ারুলকে খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে এ পর্যন্ত তিন ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন। এমনকি লাশের খণ্ডাংশ যে স্থানে বা খালে ফেলার কথা বলেছেন, সেখানে তল্লাশি করেও কিছু পাওয়া যায়নি।

এদিকে আনোয়ারুলকে হত্যার ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দুই দেশের পুলিশ যাঁকে শনাক্ত করেছে, সেই আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন নেপাল থেকেও পালিয়েছেন। তিনি নেপাল থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দিয়েছেন বলে তদন্তকারীরা তথ্য পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে গতকাল লাশ উদ্ধারে তল্লাশি করা যায়নি। ঢাকার তিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কলকাতায়।

এই খুনের ঘটনায় জড়িত হিসেবে কলকাতা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এখন পর্যন্ত যাঁদের নাম পেয়েছে, তাঁদের মধ্যে মো. সিয়াম হোসেন (বাড়ি বাংলাদেশের ভোলায়) নামের আরেক আসামিও নেপালে রয়েছেন বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তথ্য রয়েছে।

এই দুজনকে দেশে ফেরাতে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) গত শনিবার চিঠি দিয়েছে ডিবি। এনসিবি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁদের ফেরাতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে ১৩ মে কলকাতায় আক্তারুজ্জামানের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে খুন করা হয়। তদন্তকারী বলছেন, খুনের ছক সাজানোর পর ঘটনার আগে ১০ মে আকাশপথে ঢাকায় চলে আসেন আক্তারুজ্জামান। সংসদ সদস্যের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে আলোচনা তৈরি হলে ২০ মে আক্তারুজ্জামান ঢাকা থেকে ভিস্তারা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে যান। এরপর কাঠমান্ডু থেকে ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইটে তিনি দুবাই যান। সেখানে দুই ঘণ্টা ট্রানজিট নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হন বলে তথ্য পাওয়ার গেছে। আক্তারুজ্জামানের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চেতনানাশক প্রয়োগ করে আপত্তিকর ছবি তোলা হয়েছে বলে শিমুল যে তথ্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে শিলাস্তি রহমানের কথার মিল পাননি তদন্তকারীরা। জিজ্ঞাসাবাদে শিলাস্তি রহমান জানিয়েছেন, চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এই বিষয়ে ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল রোববার কলকাতায় গণমাধ্যমকে বলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামানকে দেশে ফেরাতে তাঁরা কাজ করছেন। তিনি বলেন, আক্তারুজ্জামান বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে প্রথমে কাঠমান্ডু চলে যান। সেখান থেকে দুবাই গিয়ে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন।

আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনা তদন্তে ঢাকা থেকে হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে ডিবির তিন সদস্যের তদন্ত দল গতকাল সকালে কলকাতায় পৌঁছায়। তদন্ত দলের অপর দুই সদস্য হলেন ডিবির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মু. আ. আহাদ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহিদুর রহমান। তাঁরা বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যগুলো কলকাতায় যাচাই-বাছাই করবেন বলেও জানান ডিবিপ্রধান হারুন।

আরও পড়ুন

আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনজন এবং ভারতের কলকাতায় একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। খুনের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত আরও অন্তত চারজনের নাম পেয়েছে দুই দেশের পুলিশ। এঁদের মধ্যে আক্তারুজ্জামান, সিয়ামসহ চারজন এখনো ধরা পড়েননি। বাকি দুজন হলেন ফয়সাল আলী সাজী ও মো. মুস্তাফিজুর রহমান ফকির। দুজনই খুলনার ফুলতলার বাসিন্দা। শিমুল ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত। এই দুজন এখন দেশে আছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।

কর্মকর্তাদের ধারণা, লাশ উদ্ধার যাতে না হয়, সে জন্য বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া।

জিজ্ঞাসাবাদে বিভ্রান্তিকর তথ্য

শিমুল ভূঁইয়া
ফাইল ছবি: সংগৃহীত

কলকাতায় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনায় রিমান্ডে ডিবির হেফাজতে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে তাঁর ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়াও রয়েছেন। এ ছাড়া শিলাস্তি রহমান নামের এক নারীও রিমান্ডে আছেন।

জিজ্ঞাসাবাদ-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, খুনের পরিকল্পনার আলাপ-আলোচনায় শিমুল ভূঁইয়া অ্যাপে কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার একটি ফোন নম্বর ব্যবহার করেছেন। তিনি গ্রেপ্তারের পর প্রথমে পুলিশকে বলেছিলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে একটি চেয়ারে বসিয়ে বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ টুকরা টুকরা করে খালে ফেলে দেওয়ার তথ্য দেন। পরে খুনের আরেক রকম বর্ণনা দেন। পরের ভাষ্য, খুনের উদ্দেশ্যে নয়, আপত্তিকর ছবি তুলে (ব্ল্যাকমেল করে) টাকা আদায়ের লক্ষ্যে আনোয়ারুলকে তাঁরা ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়েছিলেন। অতিরিক্ত চেতনানাশক (ক্লোরোফর্ম) প্রয়োগের ফলে আনোয়ারুলের জ্ঞান ফেরেনি। এরপর তাঁকে খুন করা হয়। এর আগে আরেকটি ভাষ্যে, খুনের আগে আনোয়ারুলের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তির কথাও বলেছিলেন শিমুল। লাশের খণ্ডিত অংশ বাইরে ফেলা নিয়েও তিনি পুলিশকে কয়েক ধরনের তথ্য দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চেতনানাশক প্রয়োগ করে আপত্তিকর ছবি তোলা হয়েছে বলে শিমুল যে তথ্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে শিলাস্তি রহমানের কথার মিল পাননি তদন্তকারীরা। জিজ্ঞাসাবাদে শিলাস্তি রহমান জানিয়েছেন, চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।

কর্মকর্তাদের ধারণা, লাশ উদ্ধার যাতে না হয়, সে জন্য বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া।

এদিকে কলকাতার পুলিশ কয়েক দিন ধরে তল্লাশি চালিয়েও আনোয়ারুলের লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। গতকাল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তল্লাশি চালাতে পারেনি বলে সেখানকার একটি সূত্র জানিয়েছে।

আরও পড়ুন