‘ভিআইপির’ ফোনে পাচারকারীর সোনা উদ্ধারে গিয়ে ফেঁসেছে পুলিশ

থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে স্বর্ণ বহনকারী নাজমুল হাসানকে মারছেন স্বর্ণ পাচারকারী সুলতান মিয়া
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

থানার পরিদর্শকের কক্ষে টেবিলের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে আছেন এক যুবক। পাশে দাঁড়ানো কোমরে পিস্তল গোঁজা এক পুলিশ সদস্য। পরিদর্শকের চেয়ারে বসা এক ব্যক্তি ওই যুবককে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। হঠাৎ যুবককে কষে চড় মারেন পুলিশ সদস্য। পরিদর্শকের চেয়ার থেকে ওই ব্যক্তি উঠে এসে যুবককে মারধর শুরু করেন। যুবক মেঝেতে পড়ে গেলে পা দিয়ে তাঁর মাথা চেপে ধরে লাথি-ঘুষি মারতে থাকেন ওই ব্যক্তি। ঘটনাটি গত বছর আগস্টের, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার। মারধরের সেই ঘটনার ভিডিও সম্প্রতি প্রথম আলোর হাতে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেল, ভিডিওতে দেখা যাওয়া পরিদর্শকের (তদন্ত) চেয়ারে বসা ব্যক্তি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা নন, তিনি স্বর্ণ পাচারকারী একটি চক্রের নেতা। নাম সুলতান মিয়া। বাড়ি মৌলভীবাজারে। দুবাই থেকে অবৈধভাবে দেশে সোনা পাঠান তিনি। পুলিশ সদস্যটি হলেন ওই থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) তারেক আজিজ। কয়েক মাস পর ঘটনাটি জানাজানি হলে এএসআই তারেককে সাময়িক বরখাস্ত এবং ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহব্বত আলীকে বদলি করা হয়েছে।

যে যুবককে মারধর করা হয়েছে, তাঁর নাম নাজমুল হাসান (৩০)। বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তিল্লি গ্রামে। চার লাখ টাকা খরচ করে গত বছর এপ্রিলে দুবাই গিয়েছিলেন তিনি। কাজ না পেয়ে চার মাস পর গত আগস্টে দেশে ফেরেন। বিমানের টিকিট কিনে দেন সুলতান মিয়া। শর্ত অনুযায়ী, সুলতানের দেওয়া দুটি স্বর্ণের বার এবং মোট ৯ ভরি ওজনের স্বর্ণের ৯টি চুড়ি বহন করতে হয় নাজমুলকে। কিন্তু দেশে ফিরে নাজমুল সেই স্বর্ণ সুলতানের লোকের কাছে পৌঁছে দেননি। এরপর সুলতানের হয়ে সেই স্বর্ণ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানিকগঞ্জ পুলিশ।

সুলতান মিয়া

মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মাদ গোলাম আজাদ খান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন ভিআইপি অনুরোধ করে বলেছিলেন, তাঁর এক আত্মীয়ের বিয়ের জন্য দুবাই থেকে সোনার অলংকার পাঠানো হয়েছে। যাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন, তিনি স্বর্ণ বুঝিয়ে দেননি। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জে। পরে আমি পুলিশ দিয়ে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করি। স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়।’

ভিআইপির নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি এসপি। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সেই ভিআইপির বাড়ি ও সুলতান মিয়ার বাড়ি একই এলাকায়।

বাইরের এক ব্যক্তি কীভাবে থানায় পরিদর্শকের চেয়ারে বসলেন এবং নাজমুলকে মারধর করলেন, সে প্রশ্নের জবাবে এসপি গোলাম আজাদ বলেন, ‘এটা আমি জানতাম না। জানার পর পরিদর্শক মহব্বত আলীকে বদলি এবং এএসআই তারেক আজিজকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদর্শক মহব্বত আলী বলেন, তিনি গত ডিসেম্বরে বদলি হয়ে কিশোরগঞ্জে এসেছেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। আর এএসআই তারেক আজিজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

ঘটনার শুরু যেভাবে

ঢাকার নবাবগঞ্জের বাসিন্দা শিউলি আক্তার গত বছরের ১৫ আগস্ট ৩৯ ভরি সোনা আত্মসাতের অভিযোগে নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে সাটুরিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তাতে তিনি বলেন, ‘আমার ফুফাতো ভাই সুলতান মিয়া দুবাই থাকেন। সেখান থেকে নাজমুলের কাছে স্বর্ণগুলো পাঠিয়েছিলেন। নাজমুল সেগুলো না দিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’ তবে নাজমুল দুবাই থেকে আনা স্বর্ণের যে বিবরণ দিয়েছেন, তার সঙ্গে জিডিতে উল্লেখ করা সোনার মধ্যে গরমিল রয়েছে।

ওই জিডির ভিত্তিতে গত বছর আগস্টের শেষ দিকে নাজমুলকে আটক করে পুলিশ। তাঁর কাছ থেকে নয়টি সোনার চুড়ি উদ্ধার করা হয়। সঙ্গে আমির নামের এক আদম ব্যাপারীকেও আটক করে পুলিশ। নাজমুলের ভাষ্যমতে, ওই আমিরের মাধ্যমে দুবাইয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরে থানায় বসে ১২ লাখ টাকায় বিষয়টির দফারফা হয়। ওই ঘটনার আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সাটুরিয়া থানার ওসির কক্ষে সুলতান মিয়ার উপস্থিতিতে টাকার লেনদেন হচ্ছে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

কে এই সুলতান

থানায় পরিদর্শকের কক্ষে নাজমুলকে সুলতানের মারধরের ঘটনা নিয়ে সমালোচনার মুখে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বিষয়টি অনুসন্ধান করে মানিকগঞ্জ পুলিশ। তাতে বেরিয়ে আসে, সুলতানের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। তিনি দুবাই বসে সোনার চোরাকারবার করেন। সেখান থেকে সোনা কিনে ফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে দেশে পাঠান। বিনিময়ে কাউকে আসার টিকিট করে দেন।

আবার কাউকে দেন নগদ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিমানবন্দর থানার একটি সোনা পাচারের মামলায় সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে এখন তিনি কারাগারে নাকি জামিনে আছেন, তা জানা যায়নি। মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, একজন ভিআইপি চোরাই সোনা উদ্ধারে তাঁদের অনুরোধ করবেন, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেননি। সোনা উদ্ধারের পর পুলিশ ওই ভিআইপিকে মামলা করার অনুরোধ করলেও তিনি রাজি হননি।

ঘটনা তদন্তসংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ভিআইপির অনুরোধের সুযোগ নিয়ে সুলতান থানায় বসে যা করেছেন, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুলতানের সোনা চোরাকারবারে জড়িত থাকার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বিপাকে আছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। জেলা পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সুলতানকে খুঁজছি।’

নাজমুল হাসান জানান, দুবাই গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে চার মাস বসে ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি দেশে ফিরে আসতে চান। তখন আমিরের লোকজন তাঁকে সুলতানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি স্বর্ণ নিয়ে আসছেন, সেই তথ্যও দুবাই থেকে আমিরকে জানানো হয়। সুলতান তাঁর কাছে মোট ৩০০ গ্রাম সোনা দেন জানিয়ে নাজমুল বলেন, ‘সুলতান সোনা পাচার করেন। তিনি নিয়মিত যাত্রীদের কাছে সোনা পাঠান।’

পুলিশের অতি উৎসাহ

নাজমুলের বাবা ইয়ার চাঁন জানান, ছেলের দুবাই থেকে ফেরার বিষয়টি তিনি জানতেন না। হঠাৎ একদিন একটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেলে করে সুলতান মিয়ার লোকজন তাঁদের বাড়িতে আসেন। তখন ছেলের ফেরার বিষয়টি জানতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাঁরা বলে আপনার ছেলের কাছে সোনা পাঠিয়েছি ,সেগুলো দেন। তাঁদের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। বলি আমার ছেলে তো দুবাইতে। তখন তারা আমাকে একটি ভিডিও দেখায়। সেখানে দেখা যায়, দুটি সোনার বার ও নয়টি সোনার চুড়ি আমার ছেলের কাছে দেওয়া হয়েছে।’

ইয়ার চাঁন জানান, সুলতানের লোকজন থাকতেই বাড়িতে পুলিশ আসে। তখন তিনি তাঁদের বলেন, আপনারা ছেলেকে উদ্ধার করে সোনা বুঝে নেন। পরে পুলিশ নাজমুলকে মানিকগঞ্জ সদর থেকে আটক করে। সোনার বারগুলো উদ্ধারের জন্য নাজমুল ও আমিরকে আটক করে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে থানায় বসে ১২ লাখ টাকায় বিষয়টির মীমাংসা হয়। তখন ছয় লাখ টাকা দিয়ে থানা থেকে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন। বাকি টাকা দেন আমির।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত লাভের আশায় ওই পুলিশ কর্মকর্তারা আইন ও প্রথাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। পুলিশে শৃঙ্খলার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।