পেটে ব্যথা, ছত্রাক সংক্রমণের কথা বলে কারাগারের বদলে তাঁরা হাসপাতালে

মাহবুবুল হক চিশতী এবং জেড এম সালেহীন

ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অনিয়মে গ্রেপ্তার মাহবুবুল হক চিশতী, মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার জেড এম সালেহীন এবং ডেসটিনির অর্থ আত্মসাতের মামলায় দণ্ডিত ওমর ফারুকসহ অনেকে বর্তমানে কারাগারের বদলে হাসপাতালে আছেন। তাঁদের কারও ছত্রাক সংক্রমণ, কারও পেটে ব্যথা, কারও ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে। হাসপাতালে থাকায় তাঁদের কারও কারও বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

এ নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিচ্ছে। তারপরও হাসপাতালে থাকায় এই আসামিদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। তারা বলেছেন, হাসপাতালে আরাম–আয়েশে থাকা এবং বিচার কার্যক্রম ব্যাহত করতে অনেক আসামি কৌশল করে হাসপাতালে থাকার চেষ্টা করছেন।

ঢাকা কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদেরকে কারাগারে পাঠানোর জন্য আমরা বারবার হাসপাতালে চিঠি দিচ্ছি। কিন্তু তারা পাঠাচ্ছে না। ১৫ দিন পরপরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়।’

১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল ফারমার্স ব্যাংকের (পরে নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক হয়) নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পর থেকে কয়েক দফায় অসুস্থতা দেখিয়ে হাসপাতালে ছিলেন তিনি। এবার দুই মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আছেন। তিনি মুখে অনিয়ন্ত্রিত ছত্রাক সংক্রমণে ভুগছেন বলে কারাগারের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৬ আগস্ট তাঁকে কাশিমপুর-১ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিএসএমএমইউয়ে আনা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মোট ১৮টি মামলা বিচারাধীন।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ফারমার্স ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী।

মাহবুবুল হক চিশতী দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকায় তাঁকে আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে বিএসএমএমইউর পরিচালক (হাসপাতাল) রেজাউর রহমানকে চিঠি দিয়েছেন কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, মাহবুবুল হক চিশতীকে আদালতে হাজির না করায় বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং আদালত কারা কর্তৃপক্ষের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন। এই বন্দীকে দ্রুত আদালতে হাজির করা প্রয়োজন। তাঁকে নিয়ে সর্বশেষ ৩০ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। মাহবুবুল হক চিশতীর বিষয়ে জানতে চাইলে রেজাউর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার নেই।’

অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালে আছেন মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার চিকিৎসক জেড এম সালেহীন। গত আগস্টের প্রথম দিকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তখন সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, সালেহীন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্রের হোতাদের অন্যতম। এই চক্র গত ১৬ বছরে ১০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। গ্রেপ্তারের পর দুই সপ্তাহ না যেতেই গত ১৯ আগস্ট থেকে সালেহীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের নবম তলার ৯০১ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন। কারাগারের নথিতে তাঁর চিকিৎসার বিষয় লেখা রয়েছে, হেমোডায়ালাইসিস (কিডনির রোগের চিকিৎসা)।

সিআইডির ভাষ্যমতে, সালেহীন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে থ্রি-ডক্টরস নামের একটি কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে তিনি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে তিনি ২০১৫ সালেও একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

এ ছাড়া ডেসটিনি গ্রুপের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের এক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ওমর ফারুকও বিএসএমএমইউতে আছেন। বলা হচ্ছে, তিনি পেটে ব্যথায় ভুগছেন। তাঁর পেপটিক আলসার রয়েছে। ওমর ফারুক ৩ অক্টোবর থেকে এই হাসপাতালে আছেন। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ১ হাজার ৮৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় গত বছর মে মাসে ওমর ফারুকসহ ৪৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন আদালত। ডেসটিনির অর্থ আত্মসাতের আরেকটি মামলার বিচার এখনো চলছে।

তাঁদের বাইরে হত্যা, অ্যাসিড–সন্ত্রাস, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক, প্রতারণা, ডাকাতি, মারামারি, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও অভিযুক্ত হাজতি ও কয়েদিরাও কারাগারের বাইরে হাসপাতালে অবস্থান করছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান জানিয়েছেন, বর্তমানে ৩২ জন বন্দী কারাগারের বাইরের হাসপাতালে আছেন।

মাহবুবুল হক চিশতী এবং জেড এম সালেহীনের দুই মাসের মতো হাসপাতালে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা কেন এত দিন ধরে হাসপাতালে আছে, সে বিষয়ে আগামীকাল আমি খোঁজ নেব।’

অসুস্থ বিএনপি নেতারাও হাসপাতালে

বর্তমানে হাসপাতালে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপির কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিস্ফোরক আইনের মামলায় আটক ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান গত ৯ সেপ্টেম্বর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল আলম ওরফে মজনু গত ২০ আগস্ট এবং সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহম্মেদ ৪ অক্টোবর থেকে বিএসএমএমইউয়ে আছেন।

কারাগার কর্তৃপক্ষের চিঠির জবাবে বিএসএমএমইউর পরিচালক রেজাউর রহমান ভিন্ন ভিন্ন চিঠিতে জানিয়েছেন, বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান, রফিকুল আলম ওরফে মজনু, সালাউদ্দিন আহম্মেদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাঁদের আদালতে হাজির করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে থাকা বিএনপির নেতারা খুবই অসুস্থ। তাঁরা যখন রাজনীতি করেন তখন স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখেন না, কারাগারে এসে যখন অফুরন্ত সময় পান তখন নিজেদের খেয়াল বাড়ে এবং ধীরে ধীরে রোগগুলোও সামনে আসতে থাকে।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমানকে আদালতের নির্দেশে হাসপাতালে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সম্প্রতি আটক বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার (দুলু) ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁকেও হাসপাতালে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে।