জামিন জালিয়াতিতে কারারক্ষীরাও, অস্ত্র মামলায় ৬০০০০, ধর্ষণ মামলায় ৪০০০০

জাল নথি তৈরি করে ধর্ষণ ও অস্ত্র মামলার দুই আসামির জামিনের চেষ্টা। ধরা পড়েছে হাইকোর্টে।

  • জামিন জালিয়াতির ১১টি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি।

  • এক কারারক্ষী গ্রেপ্তার, একজন পলাতক।

কারাগার
প্রতীকী ছবি

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে ২০১৮ সালে অস্ত্র, গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয় আবদুস সাত্তার নামের এক ব্যক্তিকে। ওই ঘটনায় করা মামলায় তাঁর ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়। তবে আবদুস সাত্তার একটি চক্রের সহায়তায় জাল নথি তৈরি করে নিজের সাজা কম দেখিয়ে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন।

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় একটি ধর্ষণের ঘটনায় ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। মামলার আসামি কবির বিশ্বাসকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। তাঁর ক্ষেত্রেও সাজা কম দেখিয়ে জামিনের আবেদন করা হয়েছিল।

অস্ত্র ও ধর্ষণ মামলার আসামিদের এত কম সাজা দেখে সন্দেহ হয় হাইকোর্টের। এরপর মামলার রায় দেওয়া নিম্ন আদালতের বিচারকদের ডাকা হয়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার আসল নথিপত্র পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট জামিন জালিয়াতির বিষয়টি ধরে ফেলেন।

চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। অস্ত্র মামলার আসামি আবদুস সাত্তার ঝিনাইদহ কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কারারক্ষী খায়রুল ও বিশ্বজিতের পরিচয় হয়। তাঁরা তখন ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের কারারক্ষী ছিলেন।
আনিচুর রহমান, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার

২০২০ সালে হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার-২ সিদ্দিকুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় ওই দুই ঘটনায় দুটি মামলা করেন। মামলা দুটির তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জামিন জালিয়াতিতে জড়িত একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে।

সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি চক্রের সদস্য নড়াইল জেলা কারাগারে কর্মরত কারারক্ষী খায়রুল ইসলাম, ঝিনাইদহ সদর থানার নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য চান্দা আলী মিয়া ও অস্ত্র মামলার আসামি আবদুস সাত্তারের বাবা নিজাম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কারাগারে থাকা আবদুস সাত্তার ও ধর্ষণ মামলার আসামি কবির বিশ্বাসকে।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রটির সঙ্গে আরও কয়েকজন কারারক্ষী জড়িত। তাঁদের মধ্যে একজন মূলহোতা। সবার নাম ও পরিচয় জানা গেছে। তবে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হওয়ায় এখনই তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। নড়াইল জেলা কারাগারের কারারক্ষী বিশ্বজিৎও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বেশ কয়েক মাস আগে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে গেছেন। নড়াইলের আগে তিনি ঝিনাইদহে কর্মরত ছিলেন।

জামিন জালিয়াতির এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিভিন্ন পদে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ ও জবাবদিহিহীনতার কারণে এসব ঘটছে।
শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

নড়াইল জেলা কারাগারের জেল সুপার মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারারক্ষী খায়রুলকে জামিন জালিয়াতির ঘটনায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে সেটা তাঁরা জানেন। বিশ্বজিৎ কর্মস্থলে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।

সিআইডি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ধর্ষণ মামলার আসামি কবির বিশ্বাস আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া জবানবন্দিতে জামিন জালিয়াতিতে জড়িতদের নাম এসেছে। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও জামিন জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইডি জামিন জালিয়াতির ১১টি ঘটনা তদন্ত করছে। কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সাজার মেয়াদ কম দেখিয়ে জামিন আবেদন করত। অস্ত্র মামলায় আবদুস সাত্তারের জামিন করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা ৬০ হাজার টাকার চুক্তি করেন। ধর্ষণ মামলার আসামি কবির বিশ্বাসের কাছে ৪০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের অধিকাংশই কারারক্ষী। দু-একজন অবসরে গেছেন।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। অস্ত্র মামলার আসামি আবদুস সাত্তার ঝিনাইদহ কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কারারক্ষী খায়রুল ও বিশ্বজিতের পরিচয় হয়। তাঁরা তখন ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের কারারক্ষী ছিলেন।

সিআইডি সূত্র বলছে, খায়রুল ও বিশ্বজিৎ ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে আব্দুস সাত্তারকে জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তাঁদের প্রস্তাবে রাজি হন আবদুস সাত্তার। পরে তিনি পরিবারের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে অগ্রিম দেন। পরে কারারক্ষী খায়রুল, বিশ্বজিৎসহ চক্রের সদস্যরা বিচারক, পুলিশ ও চিকিৎসকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নথি তৈরি করে।

জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা নথিতে মামলার এজাহারে একজনের বদলে দুজনকে আসামি দেখানো হয়। মূল আসামি আবদুস সাত্তারকে দেখানো হয় ২ নম্বর আসামি। তাঁর সাজা ১৭ বছরের বদলে উল্লেখ করা হয় ৭ বছর। জাল নথিতে আরেকটি কারসাজি করেছিল চক্রটি। সেটি হলো আসামি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে চায়নিজ কুড়াল উদ্ধার দেখানো এবং তাঁকে অসুস্থ বলে উল্লেখ করা।

ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কবির বিশ্বাসের সঙ্গেও ঝিনাইদহ কারাগারে পরিচয় হয় কারারক্ষী খায়রুল ও বিশ্বজিতের সঙ্গে। তাঁরা দুজন ও ঝিনাইদহের নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য চান্দা আলী মিয়া মিলে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে কবিরের জামিন আবেদন করেন।

সিআইডি বলছে, জামিন জালিয়াতির সঙ্গে কারারক্ষীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি নিয়ে মতামত জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, জামিন জালিয়াতির এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিভিন্ন পদে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ ও জবাবদিহিহীনতার কারণে এসব ঘটছে।