শেয়ার কেলেঙ্কারির এক মামলার তদন্তেই ২২ বছর
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিক মনে করেন, বিচারে এমন বিলম্বের কারণেই পুঁজিবাজারে অপরাধ বেড়ে গেছে।
বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারে কারসাজিতে পুঁজি হারিয়েছেন অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী। তবে প্রতিকার পাননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারসাজির হোতাদের বিচারও হয়নি। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৯৮-৯৯ সালে। জে এইচ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। সেই মামলার তদন্তে কেটে গেছে ২২ বছর।
পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার ১৬ কর্মকর্তার হাত ঘুরে সম্প্রতি জে এইচ কেমিক্যালের ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে এবারও এই জালিয়াতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিই এখন আর দেশে নেই।
অভিযোগপত্রে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহাবুবুর রহমান, তাঁর ছোট ভাই কোম্পানির পরিচালক জিল্লুর রহমান, বড় বোন ও কোম্পানির চেয়ারম্যান দিলওয়ার জাহান, তাঁর স্বামী ও কোম্পানির পরিচালক রইসুল আলম এবং তাঁদের সহযোগী ও কোম্পানির পরিচালক সুব্রত দত্তকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই পাঁচজন পরস্পর যোগসাজশে ভুয়া বরাদ্দপত্র ও শেয়ার সার্টিফিকেট বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করেছেন।
অভিযোগপত্রে এই জালিয়াতির ঘটনায় সুব্রত দত্তকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি কয়েক বছর আগেই দেশ ছেড়েছেন। বর্তমানে কানাডায় আছেন। মামলার বাদী বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক আহমদ হোসেনও চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনিও বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন। তাঁর অবর্তমানে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুবের রহমান চৌধুরী মামলার বাদী হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
যেভাবে ঝুলেছে তদন্ত
তদন্তে ২২ বছর লাগল কেন, সে প্রশ্নের জবাবে মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা (১৬তম) পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বছর দুয়েক আগে তিনি মামলার তদন্তভার পান। এরপর অভিযোগ প্রমাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জব্দ করাসহ অন্য সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করে তিনি মামলার তদন্তকাজ শেষ করেছেন।
গত ৬ ডিসেম্বর তিনি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আগের ১৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা খুব বেশি সময় ধরে যে মামলাটি তদন্ত করতে পেরেছেন, সেটি বলা যাবে না। বারবারই তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলাটি করেছিলেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক আহমদ হোসেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরই মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ তদন্তে বেশ এগিয়েছিলেন। তবে বদলির কারণে ২০০১ সালে মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করেন তিনি।
এরপর ৮ বছরে সিআইডির ১১ কর্মকর্তা মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান। তবে তাঁরা কেউই তদন্ত শেষ করতে পারেননি। ১৩তম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই কুদ্দুসুর রহমান ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। সে অনুযায়ী আদালত অভিযোগ গঠনও করেন। তবে তাতে পাঁচজনকে আসামি করা হলেও জে এইচ কেমিক্যালের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের নাম ছিল না। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের তিনজনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ দেন।
এরপর মতিঝিল থানার এসআই মো. আ. জলিল মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি শুধু সুব্রত দত্তকে অভিযুক্ত করে বাকি ১২ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন। তিনি মনগড়া অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন মর্মে আদালতে নারাজি আবেদন করেন বাদী। এরপর আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের একজন পরিদর্শকের হাত ঘুরে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম।
যেভাবে শেয়ার জালিয়াতি
তদন্তে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে জে এইচ কেমিক্যালের পরিচালক সুব্রত দত্তকে চিহ্নিত করেছে পিবিআই। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জে এইচ কেমিক্যালের অনুমোদিত মূলধন ছিল ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইস্যুকৃত ও পরিশোধিত মূলধন ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ারে বিভক্ত। এর মধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার শেয়ার হস্তান্তরযোগ্য নয়। আর ইস্যুকৃত মূলধনের মধ্যে শেয়ারবাজারে আইপিও ইস্যুর মাধ্যমে উত্তোলনযোগ্য মূলধন ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। কোম্পানিটি এই অর্থ উত্তোলনে আইপিও ছাড়ে। তবে তাদের আইপিওর মধ্যে ১৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে জমা পড়ে। কোম্পানির পরিচালকেরা বাকি ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নগদে গ্রহণ করেন।
তাঁরা পরস্পর যোগসাজশে ভুয়াভাবে পুরোপুরি সাবস্ক্রিপশন দেখিয়ে ভুয়া নামে বরাদ্দপত্র ইস্যু করেন। ভুয়া নামে ইস্যুকৃত বরাদ্দপত্রগুলো কোম্পানির পরিচালকেরা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। এর অর্থ তাঁরা কোম্পানির হিসাবে জমা না দিয়ে পরস্পর যোগসাজশে আত্মাসাৎ করেন।
এ ছাড়া ১৯৯৯ সালের ২৪ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে জে এইচ কেমিক্যালের ১ লাখ ৯৭ হাজার শেয়ার হস্তান্তরের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের দুটি ক্লিয়ারিং হাউসে জমা পড়ে। ওই সময়ে হস্তান্তরযোগ্য শেয়ারের চেয়ে ৩২ হাজার বেশি শেয়ার ক্লিয়ারিং হাউসে জমা হয়। তখন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়, কোম্পানিটির একই নম্বরের শেয়ার একাধিক গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি বন্ধ ঘোষণা করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জে এইচ কেমিক্যালের পরিচালকেরা কোম্পানির শেয়ার বরাদ্দপত্র ও তার বিপরীতে ইস্যুকৃত শেয়ার সার্টিফিকেট একই সঙ্গে অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
জালিয়াতির প্রধান অভিযুক্ত সুব্রত
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, এই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। তিনি মামলার বেশ কয়েকটি কাগজপত্র জব্দ করেন। আর পঞ্চম তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ। তিনি কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, জে এইচ কেমিক্যালের শেয়ার জালিয়াতির নায়ক হলেন সুব্রত দত্ত।
অনেক চেষ্টা করেও তিনি সুব্রতকে ধরতে পারেননি। একপর্যায়ে জানা যায়, সুব্রত দত্ত একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কানাডায় চলে যান।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, জে এইচ কেমিক্যালের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মাহাবুবুর রহমান। ১৯৮৮ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জে জে এইচ কেমিক্যাল কারখানা করেন। পরে ১৯৯৩ সালে পণ্য বাজারজাত করলে সাড়া পড়ে। পরে সুব্রত দত্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। শেয়ার ব্যবসায় ভালো জ্ঞান ছিল সুব্রতর। তাঁর পরামর্শেই ১৯৯৬ সালে জে এইচ কেমিক্যাল লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন সুব্রত জে এইচ কেমিক্যালের একজন পরিচালক হন। সুব্রত জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া শেয়ার বিক্রি করেন। পরে জে এইচ কেমিক্যালের উদ্যোক্তা মাহাবুবুর রহমান তাঁর কোম্পানি সুব্রত দত্তের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে রাগিব হাসান, নুরুল আলম, সৈয়দ আশরাফ হোসেন ও দেবব্রত দত্তকে জে এইচ কেমিক্যালের পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন সুব্রত।
তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, জে এইচ কেমিক্যালের পরিচালক সুব্রত দত্তই শেয়ার জালিয়াতির মূল খলনায়ক। তিনি এখন কানাডায় অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মুহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার তদন্তে বিলম্বের কারণ তদন্ত সংস্থাগুলো বলতে পারবে। আমরা চাই, এ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হোক।’
শেয়ার জালিয়াতির একটি মামলা কেন ২২ বছর ধরে তদন্ত পর্যায়ে ঝুলে আছে, সেটি তদন্ত করা দরকার বলে মনে করেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শেয়ার জালিয়াতির একটি মামলা তদন্তে যদি ২২ বছর কেটে যায়, তাহলে বিচার কবে হবে? বিচারে এমন বিলম্বের কারণেই পুঁজিবাজারে অপরাধ বেড়ে গেছে। অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করা না হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা ফিরবে না।