আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, এই চক্রের নেতৃত্ব দিতেন মো. সুমন (৩৫) নামের এক যুবক। তিনি একসময় ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে গড়ে তুলেছিলেন চোর চক্র। রড পরিবহনের বিভিন্ন জায়গায় লোক ঠিক করা ছাড়াও চুরির মাল কেনার ব্যবসায়ী ও কারখানার শ্রমিকদের এই অপরাধে যুক্ত করেছিলেন তিনি। এই চুরির অর্থ দিয়ে তিনি তিনটি ট্রাকের মালিক হয়েছেন।

সুমন এক দশক ধরে ট্রাক থেকে রড চুরি করে এলেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো চুরির মামলাও হয়নি। এমনকি তাঁর দলে থাকা অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোনো মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রড চুরির দুটি ঘটনার ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে সুমন ও তাঁর সহযোগীদের সম্পর্কে জানতে পারে র‌্যাব। গত ১০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও ফরিদপুরে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, সুমনের চুরির কৌশলের কারণেই তাঁরা সন্দেহের বাইরে থাকতেন। একটি রডবোঝাই ট্রাক থেকে ১৫–২০ শতাংশ রড চুরি করতেন তাঁরা। যেমন ২০ টনের একটি রডের চালান থেকে ৫–৬ টন রড চুরি করতেন। চালান কপিতে লেখা থাকে কতটি বান্ডিলে এই ২০ টন রড পাঠানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৩০টি বান্ডিলে ২০ টন রড পাঠানোর কথা বলা হয়। তবে রড ট্রাকে তোলার আগে শ্রমিকদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ওজন ঠিক রেখে ৩০টি বান্ডিলের বদলে ৩৫টি বান্ডিল করা হয়। পরিবহনের সময় ট্রাকচালক ও সহকারীর সহায়তায় মহাসড়ক থেকে পাঁচ বান্ডিল রড সরিয়ে ফেলা হয়।

র‌্যাব-৪-এর বিশেষ কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এসব রড সাধারণত চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর সময় চুরি করা হতো। মহাসড়কে যেখানে বড় সেতু রয়েছে, সেখানে ট্রাকের মালামাল পরিমাপ করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে আসার পথে মেঘনা–গোমতী সেতুতে পরিমাপ হয়। সেখান থেকে টোলের রসিদে ওজনের বিষয়টি উল্লেখ থাকে। ওই সেতু পার হওয়ার পর ট্রাক থেকে রডের বাড়তি বান্ডিলগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। আবার বঙ্গবন্ধু সেতু, ভৈরব সেতু থেকেও একইভাবে রডের ওজন হওয়ার পর বাড়তি বান্ডিলগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। চুরির এসব রড তাঁরা বৃহত্তর ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জ জেলার কিছু অসাধু রড ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে শহিদুল ইসলাম নামের ফরিদপুরের এক রড ব্যবসায়ী রয়েছেন। সদরপুর উপজেলা সদরে কলেজের পাশে শহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে তাঁর একটি রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে। অভিযানে তাঁর দোকান থেকে ৫ হাজার ৭৩১ কেজি চোরাই রড উদ্ধার করা হয়। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন চোর চক্রের কাছ থেকে কম দামে চোরাই রড কেনেন।

ফরিদপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহিদুল ইসলামের বাড়ি সদরপুরের বাবুরচরে। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। ২০০১ সালে দেশে ফিরে রড-সিমেন্টের ওই দোকান দেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি চোরাই রড কেনাবেচার ব্যবসা করেন বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানতেন।

র‌্যাব-৪-এর বিশেষ কোম্পানির স্কোয়াড কমান্ডার সহকারী পুলিশ সুপার আবুল বাশার মোল্লা বলেন, এভাবে রড সরিয়ে নেওয়া হলেও ক্রেতা যখন চালান বুঝে নেন, তখন তিনি বান্ডিলের সংখ্যা দেখেন। কারণ, ওজন স্কেলে পরিমাপ করার সময় রডের পরিমাণ ঠিক থাকার কারণে রডের ওজন নিয়ে তাঁর আর সন্দেহ হয় না।

নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদীকেন্দ্রিক ১০ চক্র

নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীকেন্দ্রিক অন্তত ১০টি রডচোর চক্রের তথ্য পাওয়া গেছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে পাওয়া এসব তথ্য এখনই প্রকাশ করতে চান না তাঁরা। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন, তাঁদের মধ্যে ৯ জন সরাসরি চুরির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের মধ্যে তিনজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে ও দুজনের বাড়ি নরসিংদীতে। নারায়ণগঞ্জের তিনজন হলেন ছোটন মিয়া, মো. রাসেল ও মো. আউয়াল। নরসিংদীর দুজন হলেন মোশাররফ হোসেন ও মো. নাসিম। অন্য চারজনের বাড়ি অন্য জেলায় হলেও তাঁরা বসবাস করেন নারায়ণগঞ্জে। চক্রের প্রধান মো. সুমনের বাড়ি বরিশালে হলেও থাকতেন সিদ্ধিরগঞ্জে। তাঁর অন্যতম সহযোগী মো. সজল, আহাদ কাজি ও মো. হামিদের বাড়ি অন্য জেলায় হলেও থাকতেন সিদ্ধিরগঞ্জে।

র‍্যাব-৪-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কে রড চুরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। চোর চক্রের পাশাপাশি চোরাই রড যেসব ব্যবসায়ী কেনেন, তাঁদেরও খুঁজে বের করা হচ্ছে। তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলেই তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।

চক্রের সন্ধান পাওয়া গেল যেভাবে

র‌্যাব বলছে, গত ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় যাওয়ার পথে ১৩ টন রড চুরি হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে সীতাকুণ্ড থানায় একটি চুরির মামলা হয়। পাশাপাশি সম্প্রতি ঢাকার সাভারে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন কাজের রড মহাসড়কে চুরি হয়। এই দুই ঘটনার ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে এই চক্রের জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। পরে ৩টি অভিযানে চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি প্রায় ২০ হাজার টন চুরির রড উদ্ধার করা হয়।