স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতার ‘সভা-সমাবেশে যান’, গ্রেপ্তার হচ্ছেন না খুনের আসামি

বোনকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দারুস সালাম থানা এলাকায় কলেজছাত্র মাহিনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেন সন্ত্রাসীরা
ছবি: সংগৃহীত

কলেজপড়ুয়া বোনকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় প্রায় দুই বছর আগে রাজধানীর দারুস সালাম থানার লালকুঠি এলাকায় কলেজছাত্র মো. মাহিন ওরফে শুভকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় করা মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তবে যাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তাঁকে এখনো গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। এ ছাড়া এই হত্যা মামলার আরও তিন আসামিকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, হত্যা মামলার এই আসামিরা ওই এলাকার বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নাবিল খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নাবিলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাঁরা প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করছিলেন। দারুস সালাম থানার পুলিশের সঙ্গে নাবিল খানের সখ্য থাকায় পুলিশ তাঁদের ধরেনি। এমনকি অভিযোগপত্র থেকেও বাদ দিয়েছে।

অভিযোগপত্রে নাম থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার না হওয়া শফিকুর রহমান ওরফে অতুলকে (২৮) শনিবারও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে নাবিল খানের সমাবেশে দেখা গেছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের বাবা মো. বাবুল। শফিকুর মিরপুর মাজার রোড এলাকার বাসিন্দা।

এ ছাড়া এই মামলায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ পেয়েছেন শাহরিয়ার কবির ওরফে হৃদয় (২৬), মো. কাউছার (২৯) ও কায়সার ইমরান ওরফে প্রদীপ (৩০)। তাঁদের মধ্যে শাহরিয়ার ও কাউছারকে নিয়মিত নাবিল খানের কর্মসূচিতে দেখা যায় বলে অভিযোগ করেছেন নিহত মাহিনের স্বজনেরা। আর কায়সার ইমরানকে এ মামলায় একবার গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁর পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ার কথা বলে অভিযোগপত্রে অব্যাহতির সুপারিশ করেছে পুলিশ। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে কাউছারকে একবার র‌্যাব ধরে দিলেও তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল দারুস সালাম থানার পুলিশ। পরে অবশ্য গত বুধবার কাউছারকে আবার ধরে নিয়ে থানায় সোপর্দ করেছেন নিহত মাহিনের স্বজনেরা।

নিহত মাহিনের বাবা বাবুল প্রথম আলোকে বলেন, মাহিন হত্যায় অংশ নেওয়া শফিকুর, শাহরিয়ার ও কাউছার প্রকাশ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা নাবিল খানের মিছিল-মিটিং করলেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। থানার পুলিশ ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে নাবিল খানের ভালো সম্পর্ক। এ সুযোগে এই আসামিরা এখন তাঁকেও খুন করার হুমকি দিচ্ছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা নাবিল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মিছিল-মিটিংয়ে শত শত লোক আসেন। এই তিনজন মিছিল-মিটিংয়ে আসছেন বলে তাঁদের আমি কোনো ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছি না।’

নাবিল খান মিরপুর এলাকার বাসিন্দা ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তারের (তুহিন) ভগ্নিপতি। ঢাকা-১৪ আসনের (দারুস সালাম-শাহ আলী এলাকা) সংসদ সদস্য আগা খান মিন্টুর আত্মীয় পরিচয় দেন তিনি।

নাবিলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তারকে ফোন করলেও তিনি ধরেননি। আর সংসদ সদস্য আগা খান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘নাবিল খান আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। সে আমার গ্রামের সম্পর্কের ভাতিজা হয়। সে আমার নাম ব্যবহার করছে।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে দারুস সালাম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আসামি কাউছার যে খুনের আসামি, সেটা ওই সময় বাদী পুলিশকে জানাননি, তাই তাঁকে ওই দিন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর খুনের আসামিকে গ্রেপ্তারে কেউ বাধা দিলে তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, তাঁকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ‘না পাওয়ায়’ মামলা থেকে অব্যাহতি

২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দারুস সালাম থানার লালকুঠির সি ব্লকের তৃতীয় কলোনিতে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা লাঠি, রড, ছুরি ও চাপাতি নিয়ে কলেজছাত্র মাহিনের ওপর হামলা চালান। সন্ত্রাসীরা তাঁকে ছুরিকাঘাত করেন ও কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যান। রক্তাক্ত অবস্থায় মাহিনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আট দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৪ সেপ্টেম্বর মাহিন মারা যান। তিনি মিরপুরে সরকারি বাঙলা কলেজে পড়াশোনা করতেন। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। মাহিনের মা মরিয়ম বেগম ছেলেকে হত্যার ঘটনায় ছয়জনের নাম উল্লেখসহও অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় মামলা করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) দারুস সালাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ সুলতান আলী এখন খিলক্ষেত থানায় কর্মরত। ২ অক্টোবর রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকালে এজাহারভুক্ত ছয় আসামি ছাড়াও মাহিন হত্যায় আরও কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় শাহরিয়ার, কাউছার ও কায়সার ইমরান ওরফে প্রদীপকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।

এসআই সুলতান আলীর দাবি, মামলায় পরে কায়সারের বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। শাহরিয়ার ও কাউছারের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হলে তাঁদের বিরুদ্ধেও সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

এ মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন রাকিব হোসেন, রাহিতুল হাসান ওরফে রিংকু, সাকলাইন খান ওরফে তামিম, রিয়াজ আহম্মেদ ওরফে রিয়াজ, সুমন আকন্দ, মো. রাকিব হোসেন, কবির হোসেন, ইমরান হোসেন, বাদল মিয়া, সিরাজুল ইসলাম ওরফে ভাতিজা সিরাজুল ও শফিকুর রহমান ওরফে অতুল। আসামিদের মধ্যে জামিনে মুক্ত আছেন রাহিতুল হাসান, সাকলাইন খান ও রিয়াজ আহম্মেদ।

‘মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতেন শফিকুর’

মাহিন হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁর বাবা মো. বাবুল সৌদি আরবে থাকতেন। মাহিনের মা মরিয়ম বেগম বলেন, ওই সময় তাঁর মেয়ে কলেজে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করতেন এজাহারভুক্ত আসামি শফিকুর। মাহিন প্রতিবাদ করায় শফিকুর ও তাঁর সহযোগীরা ক্ষিপ্ত ছিলেন। তিনি বলেন, একপর্যায়ে বখাটে শফিকুরের উৎপাতে তাঁর মেয়ের কলেজে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে মাহিনকে খুন করেন তাঁরা। কায়সার, কাউছারসহ শফিকুরের সঙ্গীরা মাদকের কারবার ও ছিনতাইয়ে জড়িত বলেও অভিযোগ করেন মরিয়ম।

মরিয়ম বেগম বলেন, ২০১৮ সালে তাঁর স্বামী সৌদি আরবে থাকার সময় এজাহারভুক্ত আসামি কাউছার, শফিকুরের সহযোগী আল আমিন, বিপ্লব ও সুমন তাঁদের লালকুঠির বাসায় ঢুকে তাঁকে ও তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়েকে মারধর করেন এবং বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখান। এ ব্যাপারে তখন দারুস সালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছিল।

পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দারুস সালাম থানার লালকুঠি ও মাজার রোড এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন শফিকুর। দারুস সালাম থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই, খুনসহ আটটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত আসামি রাকিব হোসেন, সাকলাইন খান ও বাদল মিয়ার বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

মাহিনের বাবা বাবুল পেশায় গাড়িচালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ আগস্ট মিরপুর শাহ আলী মাজারের পাশে নাবিল খানের অফিসে ছিলেন কাউছার। তিনি র‍্যাব-৪-এর একটি দলকে জানালে তারা এসে কাউছারকে আটক করে। এ খবর পেয়ে নাবিল খান এসে তাঁকে (মাহিনের বাবা) তাঁর কার্যালয়ে ঘণ্টাখানেক আটকে রাখেন। পরে র‍্যাব কাউছারকে দারুস সালাম থানায় সোপর্দ করে। কিন্তু কাউছারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই জানিয়ে তখন তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

অবশ্য গত বুধবার স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় কাউছারকে আটক করে আবার দারুস সালাম থানায় সোপর্দ করেছেন নিহত মাহিনের স্বজনেরা। এবার তাঁকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের অনুমতিতে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

নিহতের বাবাকে কার্যালয়ে আটকে রাখার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাবিল খান বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে আমার মার্কেটে ঢুকে পড়েন মাহিনের বাবা। এত রাতে কেন মার্কেটে ঢুকেছেন, তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। তাঁকে আটকে রাখা হয়নি।’