নিরপরাধীদের হয়রানি ঠেকাতে পুলিশের অনুসন্ধান স্লিপে থাকবে আসামির ছবি

অনুসন্ধান স্লিপের প্রস্তাবিত কপিছবি: পুলিশের সৌজন্যে

রাজধানীর পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমান গ্রেপ্তার হন ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। এরপর পাঁচ বছর কারাভোগ করেন। অথচ যে মাদক মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেটির প্রকৃত আসামি শাহাবুদ্দিন বিহারি ওরফে আরমান নামের এক মাদক কারবারি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে নিরপরাধ একজন বেনারসি কারিগর কেন সাজা খাটলেন? এর কারণ পুলিশের অনুসন্ধান বা যাচাইকরণ স্লিপ, যেটির দাপ্তরিক নাম বিপি ফরম নম্বর-৭৭।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশের এই অনুসন্ধান স্লিপে আসামি শাহাবুদ্দিন বিহারি আরমানের নামের একাংশের সঙ্গে মো. আরমানের নাম মিল ছিল। এ ছাড়া দুজনের শ্বশুরের নাম একই। এ কারণে গ্রেপ্তার হন নিরপরাধ আরমান, তাঁকে জেলে যেতে হয়।

শুধু আরমান নন, এমন অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি পুলিশের ভুলে কারাগারে গেছেন। নাম ও ঠিকানায় মিল থাকায় অপরাধ না করেও ২০০৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের মোংলা থানায় ইলেকট্রনিক সামগ্রী চুরির মামলায় চার মাস সাজা খাটেন মো. আবদুস সালাম ঢালী নামের এক ব্যক্তি। তিনি খুলনা নগরীর শেখপাড়া এলাকার মফিজ উদ্দিন ঢালীর ছেলে। এ মামলার প্রকৃত আসামি খুলনার শেখপাড়া মেইন রোডের প্রয়াত শফিজ উদ্দিনের ছেলে মো. আবদুস সালাম। আদালতের আদেশে ২০২০ সালের ৬ জুলাই মুক্তি পান নিরপরাধ সালাম ঢালী।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিরপরাধ মানুষের হয়রানি বা কারাভোগ ঠেকাতে অনুসন্ধান স্লিপে আসামির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, আসামির স্থলে নিরপরাধ ব্যক্তি গ্রেপ্তার, কারাভোগ বা হয়রানির শিকার না হয়, সে জন্য অনুসন্ধান স্লিপ বা ফরমে আসামির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র যুক্ত করা হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে এরই মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে এ ব্যাপারে আবেদন করা হয়েছে। এখন আইজিপি বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে পুলিশ প্রবিধান সংশোধনে ব্যবস্থা নেবেন।

নামের মিল থাকায় গ্রেপ্তার হন আরমান

২০০৫ সালের ৩০ আগস্ট রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনে একটি ফ্ল্যাট থেকে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ শাহাবুদ্দিন বিহারি ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। পল্লবী থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা হয়। সে সময় শাহাবুদ্দিন তাঁর ডাকনাম ‘আরমান’ বলে জানান। দুই বছর জেল খাটার পর ২০০৭ সালের ৫ মার্চ জামিন পান শাহাবুদ্দিন। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শাহাবুদ্দিন ওরফে আরমান ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে স্বাক্ষরযুক্ত জামিননামার মাধ্যমে জামিন নেন শাহাবুদ্দিন। এরপর তিনি গা ঢাকা দেন। ২০১২ সালের ১ অক্টোবর শাহাবুদ্দিন বিহারি ও তাঁর দুই সহযোগীর প্রত্যেকের ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন আদালত। পলাতক শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্লবী এলাকা থেকে মো. আরমানকে গ্রেপ্তার করেন পল্লবী থানার এসআই মো. রাসেল। এ সময় আরমানকে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে পিবিআইয়ের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পুলিশ সুপার মো. আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট থানায় আসামির নাম–ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য অনুসন্ধান স্লিপ পাঠান। পল্লবী থানার পুলিশ আরমানের নাম শাহাবুদ্দিন আরমান এবং তাঁর শ্বশুরের নাম (মৃত) মো. ইয়াছিন লিখে ডিবির কাছে পাঠায়। আসামি শাহাবুদ্দিনের শ্বশুরের নামও মো. ইয়াছিন। ডিবি পুলিশ সেভাবে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পরে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে পল্লবী থানার পুলিশ আরমানকে শাহাবুদ্দিন আরমান বলে গ্রেপ্তার করে।

যাচাই–বাছাইয়ের পর পিআরবি সংশোধন

পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো পিবিআইয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, বিনা দোষে গ্রেপ্তার আরমানকে নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন যুক্ত করে ২০২১ সালের ১৫ জুন তাঁর মা বানু বেগম হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রিটে এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আরজি জানান এই মা। পরে হাইকোর্ট এ ব্যাপারে দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন এবং একই সঙ্গে পিবিআইয়ের প্রধানকে তদন্ত কমিটি গঠন করে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন।

পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধান স্লিপে সংশোধনের ব্যাপারে আদালতের কাছে আদেশ দেওয়ার অনুরোধ করলে আদালত বলেন, যেহেতু এটি প্রশাসনিক বিষয়, তাই এটি দাপ্তরিকভাবে সংশোধন করা যাবে। এরপর তা কার্যকর হবে। গ্রেপ্তারের সময় আসামির ছবি তুলে রেখে তা পরে অনুসন্ধান স্লিপে যুক্ত করে দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন প্রথম আলোকে বলেন, পিবিআইয়ের পাঠানো আবেদনসহ প্রস্তাবিত অনুসন্ধান স্লিপ তিনি পেয়েছেন। একটি কমিটি করে যাচাই–বাছাইয়ের পর পিআরবি সংশোধনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

‘নিরপরাধ মানুষের হয়রানি বন্ধ হবে’

পিবিআইয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী পিবিআইয়ের গঠিত তিন সদস্যের কমিটি ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে আদালত সুপারিশ পেশ করেন। সুপারিশ অনুযায়ী কোনো আসামির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুলিশের প্রচলিত নিয়ম ও বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধান স্লিপ (বিপি ফরম নম্বর-৭৭) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে তথ্যের অপর্যাপ্ততা ও অসম্পূর্ণতার কারণে সঠিক ব্যক্তি শনাক্তকরণে সমস্যা দেখা দেয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা সমাধানে পিবিআই প্রচলিত অনুসন্ধান স্লিপকে ভিত্তি করে একটি প্রস্তাবিত অনুসন্ধান স্লিপ হাইকোর্টে দাখিল করে। হাইকোর্ট বিষয়টি রেকর্ডভুক্ত করার আদেশ দেন।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস পাল প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। অনুসন্ধান স্লিপে আসামির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র যুক্ত থাকলে নকল গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সুযোগ থাকবে না এবং নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবেন না। এ ছাড়া ভুল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।