দুবাইয়ে বসে ভিডিও কনফারেন্সে জাহিদুলকে হত্যার নির্দেশ দেন দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী

জাহিদুল ইসলাম
ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে হত্যা করতে রাজধানীর দুটি রেস্তোরাঁয় দুই দফায় বৈঠক করেন সন্ত্রাসীরা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম বৈঠকে অংশ নেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ও জাফর আহমেদ ওরফে মানিক। তাঁরা জাহিদুলকে হত্যার নির্দেশ দেন।

জাহিদুল হত্যায় গ্রেপ্তার সুমন শিকদার ওরফে মুসার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আদালত ও মামলার তদন্ত সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি সুমন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁর জবানবন্দিতে এই হত্যায় জড়িত ১৬ জনের নাম উঠে এসেছে। তাঁদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার নাম হত্যা মামলা থেকে বাদ দিতে বিভিন্ন মহল থেকে তদন্ত কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

জাহিদুল হত্যাকাণ্ডের পর দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন সুমন। গত বছরের ৯ জুন ওমান থেকে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনে পুলিশ। পরে তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

আরও পড়ুন

গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

জাহিদুল হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শাহাজাহানপুর থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তারা বলছে, জাহিদুল হত্যায় মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র‍্যাব। তাঁদের মধ্যে হত্যার পরিকল্পনাকারী সুমন, ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও নাসির উদ্দিন ওরফে মানিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আদালত সূত্র জানায়, জাহিদুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাকিবুর রহমান, ইয়াসির আরাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ, মশিউর রহমান ও আরিফুর রহমান (এক্সেল সোহেল)।

ডিবি ও আদালত সূত্র জানায়, সুমন তাঁর জবানবন্দিতে নিজেকে রাজধানীর পল্লবী এলাকার ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। তিনি নিজেকে প্রথম শ্রেণির ঠিকদার বলেও দাবি করেন। জবানবন্দিতে সুমন বলেন, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় ‘শুটার’ মাসুম কাছ থেকে জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করেন। ঘটনার সময় তাঁকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন শামীম।

সুমন জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারের ছোট ভাই টিটুকে ফোন দেন। তিনি তাঁকে বায়তুল মোকাররমের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘রুফটপ’ রেস্তোরাঁয় থাকতে বলেন। সেদিনই তিনি সেখানে যান। সেখানে আশরাফ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ ওরফে মনসুর, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ার ওরফে রানা, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা ওরফে সাগর, মোল্লা রানা, এক্সেল সোহেল, আমিনুল ওরফে আমিনুর, বাবুল তালকুদার, রিফাত, টিটু ও খাইরুলকে দেখতে পান। বৈঠকে ঠিকাদারি ও স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে কথা শুরু হয়। একপর্যায়ে সোহেল শাহরিয়ার রেগে গিয়ে বলেন, জাহিদুল টেন্ডারের মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু তাঁদের কাছে এসবের সঠিক হিসাব দেন না।

আরও পড়ুন

জবানবন্দিতে সুমন বলেন, মারুফ ডিশের ব্যবসা করেন। তাঁর লোকজন ডিশের লাইন দিতে শাহজাহানপুরে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের মারপিট করেন জাহিদুলের লোকজন। এ ঘটনায় মারুফ মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ জাহিদুলের লোকদের গ্রেপ্তার করেনি। উল্টো জাহিদুল পুলিশের কাছে মারুফের বিরুদ্ধে বিচার দেন। তখন মারুফ রাগারাগি করেন। ‘রুফটপ’ রেস্তোরাঁর বৈঠকে সবাই জাহিদুলের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকে সোহেল শাহরিয়ার বলেন, জিসান ও মানিক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে যে ১০০ ছাত্র ভর্তির কথা বলেছিলেন, তার কী হলো? তখন মারুফ বলেন, এ নিয়ে জাহিদুলের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। কিন্তু জাহিদুল এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। জিসান ও মানিককে ভর্তি-বাণিজ্যের ভাগ দিতে হলে তা অন্যদের অংশ থেকে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন জাহিদুল। তখন রিফাতের মুঠোফোন দিয়ে দুবাইয়ে থাকা মানিককে ফোন দেন সোহেল শাহরিয়ার। তিনি জিসানকেও এই বৈঠকে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেওয়ার জন্য মানিককে বলেন। এরপর জিসান ও মানিক উভয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন। তাঁরা জাহিদুলের কর্মকাণ্ডের নিয়ে রাগারাগি করেন। এ সময় খালেদ ও জাহিদুলের লোকদের এলাকাছাড়া করতে নির্দেশ দেন জিসান। আশরাফ-মারুফকে উদ্দেশ্য করে জিসান ও মানিক বলেন, জাহিদুলকে মেরে ফেলতে হবে। জাহিদুল না থাকলে সবাই সুবিধা পাবেন।

সুমন জবানবন্দিতে বলেন, বৈঠকে অংশ নেওয়া রবিনকে দুই দিনের মধ্যে দুই লাখ টাকা ব্যবস্থার দায়িত্ব দেন মারুফ। তবে সোহেল শাহরিয়ার এক্সেল সোহেলকে তিন লাখ, মারুফকে পাঁচ লাখ, রবিনকে দুই লাখ, বাবুলকে তিন লাখ ও টিটুকে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলেন। এই টাকা জাহিদুল হত্যায় ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়। সেদিন রেস্তোরাঁর বিল দেন টিটু।

আরও পড়ুন

জবানবন্দিতে সুমন বলেন, রুফটপ রেস্তোরাঁয় বৈঠকের সপ্তাহখানেক পর তিনি ঢাকার বাইরে যান। তখন শামীম তাঁকে ফোন দেন। বলেন, রানা মোল্লা তাঁকে খুঁজছেন। রানা মোল্লা তাঁকে ঢাকায় আসতে বলেছেন। ঢাকায় ফিরে রানা মোল্লাকে ফোন দেন সুমন। তাঁকে রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউসে আসতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে তিনি সোহেল শাহরিয়ার, মোল্লা রানা, এক্সেল সোহেল, আমিনুল, শামীম ও রিফাতকে দেখতে পান। সেখানে বসে মানিককে ফোন দেন এক্সেল সোহেল। তিনি মানিকের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র চান। তখন মানিক তাঁকে বলেন, শামীমের কাছে একটি অস্ত্র আছে। জিসান আরেকটি অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেবেন। পরে জিসানকে ফোন দেন এক্সেল সোহেল। তিনি ইমতিয়াজ জিতুকে তাঁর অস্ত্রটি দিয়ে দিতে বলেন।

সুমন জবানবন্দিতে বলেন, দ্বিতীয় বৈঠক শেষে আশরাফ ও মারুফ বলেন, কোনো কিছু লাগলে তাঁরা (জিসান-মানিক) ব্যবস্থা করে দেবেন। এ সময় সোহেল শাহরিয়ার বলেন, সারা জীবন জাহিদুলের সঙ্গে থেকে তিনি কিছু পাননি। সমর্থন পেলে তিনি মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে চান। তখন সোহেল শাহরিয়ারকে আশরাফ বলেন, ‘তুমি কাজ চালাও, আমি দেখব।’ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জাহিদুলকে মতিঝিল কলোনিতে খুন করা যাবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়, এখানে খুন করলে সবাই ফেঁসে যাবেন। খুনের কাজ করতে হবে ওয়ার্ডের বাইরে। বৈঠকে জাহিদুল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা শামীমকে জানানোর জন্য আমিনুল ও সোহেল শাহরিয়ারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শাহজাহানপুরের মির্জা আব্বাস কলেজের আশপাশে থাকার জন্য রানা মোল্লা, উজ্জ্বল ও এক্সেল সোহেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আর শাহজাহানপুরের আমতলা থেকে জাহিদুলের রেললাইনের বাসা পর্যন্ত নজরদারির দায়িত্ব রিফাতকে দেওয়া হয়। শামীমকে মোটরসাইকেল কেনাসহ খরচ চালাতে দুই লাখ টাকা দেওয়া। রানা মোল্লা, আমিনুল ও রিফাতকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সবাই চলে যান।

আরও পড়ুন

জবানবন্দিতে সুমন বলেন, গত বছরের ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি মানিক ও জিসান তাঁকে ফোন করেন। তাঁরা জাহিদুলকে খুন করার কাজটি দ্রুত শেষ করতে বলেন। তাঁরা প্রায় প্রতিদিন ফোন করতেন। পরে জিসানের নির্দেশনা অনুযায়ী, জাহিদুলকে হত্যার জন্য সাগরের কাছ থেকে ১৫টি গুলি সংগ্রহ করা হয়। তিনি (সুমন) এই হত্যাকাণ্ডের সামগ্রিক ঘটনায় জড়িত ছিলেন। জাহিদুল হত্যাকাণ্ডের পর সবাই এখন সুবিধা ভোগ করছেন। আর তিনি ফেঁসে গেছেন।

জবানবন্দিতে নাম আসার বিষয়ে বক্তব্য জানতে আজ শুক্রবার দুপুরে কাউন্সিলর মারুফকে মুঠোফোনে কল করা হয়। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তিনি অবগত নন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সম্পর্কে কিছু জানেন না।

মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, জাহিদুল হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। কিন্তু কয়েকজনের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে। মূলত এ কারণেই মামলার তদন্ত এগোচ্ছে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তার ২৫ জনের বাইরে আরও কিছু ব্যক্তি জাহিদুল হত্যায় জড়িত। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আসামিদের তদবির আছে। কিন্তু আমরা তা আমলে নিচ্ছি না। মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তদন্ত শেষে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’

মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া ও জামিনে আসামি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাদী জাহিদুলের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফোন দিয়ে আমাকে বলা হচ্ছে, চারজনের নাম যাতে না আসে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে একে একে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছেন আসামিরা। এ অবস্থায় হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে সন্তানদের নিয়ে আমার দিন কাটছে।’