বাইরে জানাজানি হওয়ায় সুস্থ ফিরোজকে ‘ওষুধ খাইয়ে নিস্তেজ করা হয়’

উত্তরার এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্ত সাজিয়ে ২২ দিন আটকে রাখা হয় ফিরোজ আহমেদকে
ছবি: রেইনবোর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

সাভারের আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার কর্মী ফিরোজ আহমেদ। তাঁকে মাদকসেবী সাজিয়ে ঢাকার উত্তরার রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২২ দিন আটকে রাখা হয়। প্রথম স্ত্রী আকলিমা আক্তারের পরিবার ফিরোজকে সেখানে আটকে রাখে। বিষয়টি জানাজানি হয় ২২ দিন পর। এরপরই ৪ অক্টোবর রাতে তড়িঘড়ি করে ফিরোজকে আকলিমার পরিবারের কাছেই পৌঁছে দেয় রেইনবো। সেদিন রাতে মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে ছাড়া পেলেও তাঁর জিম্মিদশা কাটেনি। আকলিমার পরিবার আবার তাঁকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। তবে এক দিন পর (৫ অক্টোবর) রাতে সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি নাটোরে যান তিনি।

গত বুধবার বিকেলে মুঠোফোনে ফিরোজ পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন প্রথম আলোর কাছে। তিনি বলেন, ১২ অক্টোবর জিরাবোতে আকলিমার (প্রথম স্ত্রী) বাসায় যান ফিরোজ। এ সময় আকলিমার ভাই মোজাম্মেল হক মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ফিরোজকে আটকে রাখেন। পরদিন (১৩ সেপ্টেম্বর) তিনজন এসে তাঁকে একটি প্রাইভেট কারে তুলে উত্তরার রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাঁদের একজন হলেন বোরহান দেওয়ান (রেইনবোর ব্যবস্থাপক)।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রে আটকে রেখে বোরহান দেওয়ান ২০ লাখ টাকা দাবি করেন জানিয়ে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘আমাকে বোরহান তাঁর ছোট বোনের স্বামী বলে রিহ্যাবে (মাদক নিরাময় কেন্দ্র) ঢোকান। দ্বিতীয় দিন এসে তিনি (বোরহান) বলেন, ছোট (দ্বিতীয়) স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে হবে। আর আকলিমাকে (প্রথম স্ত্রী) ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। তা না হলে পরিণতি হবে ভয়ংকর। আরও খারাপ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে আপনাকে।’

ফিরোজ ১২ বছর আগে আকলিমাকে বিয়ে করেন। এর তিন বছর পর তিনি গোপনে নাজমা আক্তার নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। আকলিমা থাকেন আশুলিয়ার জিরাবোতে। আর নাজমা থাকেন সাভারে। তবে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি ৯ বছর ধরে গোপন ছিল।

ফিরোজ আহমেদ বলেন, বিয়ের দুই বছর পর জানতে পারেন, শারীরিক সমস্যার কারণে আকলিমা মা হতে পারবেন না। এ কারণেই তিনি গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

চার মাস আগে আকলিমার পরিবার বিষয়টি জেনে যায়। তখন চার দিন জিরাবোতে তাঁকে (ফিরোজ) আটকে রাখে। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য সালিস করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আকলিমার নিরাপত্তার জন্য ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। আর দুই স্ত্রীর সঙ্গেই তিনি সংসার করবেন। তখন ১০ লাখ টাকাও দেন তিনি। তবে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে আকলিমার সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে তাঁকে আবার জিম্মি করা হয়। ওই সালিসের মধ্যস্থতা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত দেওয়ান।  

এ বিষয়ে লিয়াকত দেওয়ানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে বিষয়বস্তু লিখে বক্তব্য চাওয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি।

তবে ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমা আক্তার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ফিরোজ ব্যবসার কথা বলে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। ওই টাকা আদায় করা হয়েছে। আর ২০ লাখ টাকা দাবির বিষয়টি মিথ্যা বলেও দাবি করেন তিনি।
ফিরোজ মাদকাসক্ত বলেই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে দাবি করে আকলিমা আক্তার বলেন, কোনো সুস্থ মানুষকে তো আর মাদক নিরাময় কেন্দ্র দেওয়া হয় না। মাদকাসক্ত বলেই দেওয়া হয়েছে। আর তাঁকে কখনো আটকে রাখা হয়নি, নির্যাতনও করা হয়নি। উল্টো বিভিন্ন সময় ফিরোজ তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছেন।

আকলিমার ভাই মোজাম্মেল হকও দাবি করেন, ফিরোজ মাদকাসক্ত। মাদক সেবন করে বিভিন্ন সময় তাঁর বোনের ওপর নির্যাতন করতেন। এ কারণেই তাঁকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়।

যেভাবে মুক্ত হলেন

ফিরোজের ভাষ্য, ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা তখন বলছিলেন, বিষয়টি বাইরে জানাজানি হয়ে গেছে। ফিরোজকে ছেড়ে দিতে হবে। ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁকে জোর করে ওষুধ খাওয়ানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর তাঁকে আশুলিয়ায় প্রথম স্ত্রী আকলিমার পরিবারের কাছে দিয়ে আসেন নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন। ওষুধের কারণে তখন তিনি ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না।

ফিরোজ বলেন, আকলিমার পরিবার তাঁকে আটকে রেখে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। সব সম্পত্তি লিখে না দিলে তাঁকে ছাড়া হবে না বলেও জানানো হয়। পরদিন (৫ অক্টোবর) রাত ৯টার দিকে ফিরোজকে অন্য একটি স্থানে স্থানান্তর করছিল আকলিমার পরিবার। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর পেছন থেকে তিনি দৌড়ে পালিয়ে একটি জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েন। একটি গাছে উঠে তিনি দীর্ঘ সময় বসে থাকেন। রাত গভীর হওয়ার পর তিনি হেঁটে বাইপাইল এলাকায় যান। নাটোরের একটি বাস উঠে তিনি সুপারভাইজারকে বলেন, অনেক বিপদে পড়েছেন। তাঁকে যেন নাটোরে পৌঁছে দেওয়া হয়। নাটোরে পৌঁছে তিনি মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

নিরাময় কেন্দ্র বলছে ‘ভুল হয়েছে’

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ২২ দিন আটকে রাখা ফিরোজকে শেষ মুহূর্তে জোর করে নেশাজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত

একজন সুস্থ মানুষকে মাদকসেবী সাজিয়ে ২২ দিন আটকে রাখার বিষয়ে রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র বলছে, এটা তাদের ভুল হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এফ এম কাউসার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টির জন্য দায়ী ব্যবস্থাপক বোরহান দেওয়ান। আত্মীয়ের পরিচয়ে নিরাময় কেন্দ্রে ফিরোজকে বোরহান নিয়ে আসেন। এ ঘটনার কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র চেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ ঘটনায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

ফিরোজকে বাসা থেকে নিয়ে আসার পর আটকে রেখে ২০ লাখ টাকা দাবির বিষয়ে বোরহান দেওয়ান বলেন, তাঁকে বিপদে ফেলতে এ ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে। ফিরোজের অতীত ইতিহাস তিনি জানতেন না। তবে ফিরোজ মাদকাসক্ত নন জানার পর তাঁকে ফিরিয়ে নিতে তাঁর প্রথম স্ত্রীর পরিবারকে বলেছেন। কিন্তু তারা ফিরোজকে ফিরিয়ে নেয়নি। এ কারণে তাঁকে ছাড়া হয়নি।

এভাবে সুস্থ লোককে মাদকাসক্ত সাজিয়ে ওষুধ প্রয়োগের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর উত্তর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মেহেদি হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাদের জবাব পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের সহায়তা পাননি ফিরোজ

গত ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সাভারে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসা থেকে বের হন ফিরোজ। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। স্বামীর খোঁজ না পেয়ে ১৯ দিন পর ১ অক্টোবর ফিরোজের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজমা আক্তার সাভার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এই জিডির তদন্ত করেন সাভার থানার এসআই হাসান শিকদার। তদন্ত শুরুর পরই তিনি জানতে পারেন, ফিরোজকে তাঁর প্রথম স্ত্রী আকলিমা মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করেছেন। তবে উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ তিনি নেননি।

এ বিষয়ে ফিরোজের মা জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাভার থানা থেকে তখন বলা হয়েছিল, ফিরোজে লুকিয়ে রেখে নাটক করছে। ফিরোজের খোঁজ পাওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সহযোগিতা পাইনি। এমনকি ফিরোজকে মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে প্রথম স্ত্রী আকলিমার পরিবার নিয়ে যাওয়ার পর সাভার থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তখন দুর্ব্যবহার করে ফোন কেটে দেন তদন্ত কর্মকর্তা।’

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হাসান শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।

কিন্তু সরকারি অনুমোদন আছে, এমন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি কাউকে উদ্ধার করার এখতিয়ার পুলিশের নেই। এ কারণে সেখানে অভিযান চালানোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি পাননি। পরে পরিবারকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফিরোজ নিরাময় কেন্দ্র থেকে ছাড়া পেয়েছেন, এমন তথ্যও জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।