লুটের অস্ত্রে চলছে ছিনতাই-লুটপাট, ১৩৬৩টির হদিস নেই এখনো

উদ্ধারকৃত পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গুলিফাইল ছবি

চট্টগ্রামে গত মে মাসে মো. পারভেজ ও রিয়াজুর রহমান নামের দুজন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের কাছ থেকে নগরের পাহাড়তলী থানা থেকে লুট হওয়া রিভলবার ও গুলি উদ্ধার করা হয়। তাঁরা এই অস্ত্র দিয়ে ছিনতাই-লুটপাট করতেন বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেন।

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংস্থাটির লুট হওয়া অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলো অপরাধীদের হাতে চলে গেছে, অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের সময় কারাগার থেকে পালানো সাত শতাধিক বন্দী এখনো ধরা পড়েননি। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগই উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্র-গুলি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। এগুলো উদ্ধারে অভিযান চলছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা নেই।

আরও পড়ুন

অস্ত্র লুট ও উদ্ধার

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি, বক্সসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। এসব জায়গা থেকে ৫ হাজার ৭৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। গোলাবারুদ লুট হয় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।

লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এই অভিযানে চলতি বছরের ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আর গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১১২টি।

লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, অভিযানে চলতি বছরের ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আর গোলাবারুদ উদ্ধার হয় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১১২টি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত সময় (গত ২৮ জুলাই) পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি।

লুটের অস্ত্রে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

গত ৪ এপ্রিল খুলনা মহানগরে অভিযান চালিয়ে ফারুক হোসেন (২৩) ও খাইরুল সরদার (২৭) নামের দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি শটগান ও শটগানের সাতটি গুলি উদ্ধার করার কথা পুলিশ জানায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, উদ্ধার করা শটগান ও গুলির গায়ে লেখা ছিল ‘বিডি পুলিশ’। এগুলো পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র-গুলি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক স্বীকার করেন, তিনি বিভিন্ন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দুষ্কৃতকারীদের কাছে অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা করে আসছিলেন।

চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলিসহ আরিফ হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় গত ১৭ এপ্রিল। সে সময় পুলিশ বলে, লুটের অস্ত্র-গুলি ব্যবহার করে নগরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি করতেন আরিফ।

গত ১৯ জুন চট্টগ্রামের জেলেপাড়া রানী রাশমণিঘাট এলাকা থেকে সাইদুর রহমান মাসুম ওরফে রেড মাসুম (২৮) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর কাছ থেকে একটি পিস্তল ও চারটি গুলি উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) হোসাইন মোহাম্মদ কবির ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, মাসুম নগরীর বড় একটি সন্ত্রাসী চক্রের প্রধান। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা পিস্তলটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা থেকে লুট করা হয়েছিল। এই অস্ত্র ব্যবহার করে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধ করতেন।

থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারসহ জেল পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো অভিযান চালাতে হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তা করতে হবে, তা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এর আগে গত ১৭ জুন একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, দুটি গুলিসহ কাভার্ড ভ্যানচালক মো. রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলে, এগুলো চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা থেকে লুট হয়েছিল।

গত ৩ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় ডাকাত সন্দেহে মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ সালেক (৩৫) নামের দুই ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হন। উপজেলা জামায়াতে ইসলামী সে সময় নিহত দুজনকে নিজেদের কর্মী দাবি করে বলেছিল, একটি সালিসের কথা বলে তাঁদের ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল ইসলাম তখন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, মৃত্যুর আগে নেজামের পিস্তল দিয়ে চালানো গুলিতে স্থানীয় এক দোকানিসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। পিস্তলটি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানা থেকে লুট হয়েছিল।

গত বছরের ৩০ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে শাহিদা আক্তার (২২) নামের এক তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় শাহিদার কথিত বন্ধু তৌহিদ শেখ ওরফে তন্ময় গ্রেপ্তার হন। পরে পুলিশ বলে, ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করেন তৌহিদ। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন

জেলপলাতক সাত শতাধিক বন্দী অধরা

কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে-পরে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। কারাগার থেকে ২ হাজার ২৪০ বন্দী পালান। বিভিন্ন কারাগার থেকে ৯৪টি শটগান ও চায়নিজ রাইফেল লুট হয়। পালানো বন্দীদের মধ্যে ৭২১ জন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর কারাগার থেকে লুট হওয়া ২০টি শটগান ও চায়নিজ রাইফেল এখনো উদ্ধার করা যায়নি।

কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ধরা না পরা বন্দীদের মধ্যে ৬৯ জন ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদের মধ্যে ৬০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও ৯ জন জঙ্গি। এ ছাড়া কারাগার থেকে লুট হওয়া কিছু চায়নিজ রাইফেল ও শটগান এখনো উদ্ধার হয়নি। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে তাঁর মনে হয়। তবে বর্তমান অবস্থায় তাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটাতে পারবেন না।

আরও পড়ুন

‘জোরালো অভিযান দরকার’

সার্বিক বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের লুট হওয়া সব অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লাইসেন্সবিহীন অনেক অস্ত্র বাইরে রয়েছে। পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। এ কারণে খুনখারাবি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি বেড়েই চলছে। থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারসহ জেল পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো অভিযান চালাতে হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তা করতে হবে, তা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আরও পড়ুন