ভারতীয় নারী পরিচয়ে বন্ধুত্ব, ফাঁদে পড়ছেন বাংলাদেশি আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক

এই ছবি পাঠিয়ে ভারতীয় নারী কর্মকর্তা পরিচয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছে এক বাংলাদেশিকেছবি: সংগৃহীত

ঢাকার একজন চিকিৎসকের কাছে ফেসবুকে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠান অঞ্জলি শর্মা। নিজেকে পরিচয় দেন ভারতের রাজস্থানের আইপিএস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস) কর্মকর্তা হিসেবে। পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দেখে বন্ধুত্বের অনুরোধে সাড়া দেন চিকিৎসক। ফেসবুক মেসেঞ্জারে দুজনের মধ্যে কথা শুরু হয়। কথা বলার একপর্যায়ে চিকিৎসকের মুঠোফোন নম্বর জেনে নেন অঞ্জলি। সপ্তাহখানেক পর হঠাৎ চিকিৎসককে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল করেন তিনি। কল ধরে কথা বলতেই মুঠোফোনে ভেসে উঠে এক নারীর অশ্লীল দৃশ্য।

কৌশলে ওই নারীর সঙ্গে চিকিৎসকের কথোপকথনের সেই দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে সেই ভিডিও পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয়। লজ্জা ও ভয়ে হুমকি দেওয়া ব্যক্তিদের পাঠানো মুঠোফোন আর্থিক সেবার (এমএফএস) নম্বরে ৬৫ হাজার টাকা পাঠান চিকিৎসক। গত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ ঘটনা ঘটে।

শুধু ওই চিকিৎসক নন, গত ডিসেম্বর মাসে ঢাকার উপসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সঙ্গে একইভাবে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয় চেন্নাই বিমানবন্দরের মহিলা কাস্টমস কর্মকর্তা স্বপ্না সিং পরিচয় দেওয়া একজনের সঙ্গে। একই কায়দায় ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে টাকা দাবি করা হয়। তিনি টাকা না দেওয়ায় ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয় ওই কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতনদের কাছে। পরে তাঁকে ঢাকা থেকে বরিশালে বদলি করা হয়। পরিবারেও ঝামেলা শুরু হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, মেয়র, আমলা, ব্যবসায়ী, ছাত্রলীগ নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এই প্রতারক চক্রে ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকেরাও রয়েছেন। রাজধানীর পল্লবী ও যাত্রাবাড়ী থানার দুটি মামলার তদন্তে নেমে এই চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগ। সম্প্রতি চক্রের চারজনকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। পরে তাঁদেরকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণা সম্পর্কে জানতে পারেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

ফোন আসে ভারত থেকে, টাকা নেন বাংলাদেশিরা

ডিবির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ভারতীয় পুরুষেরা ফেসবুকে নারী কর্মকর্তা, স্কুলশিক্ষিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পরিচয় দিয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বড় সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলছেন। ভারতের এসব নাগরিক হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তাঁরাই মূলত কল দিয়ে ভিডিও ধারণ করতেন। আর চক্রের বাংলাদেশি সদস্যরা হুমকি দিয়ে মুঠোফোন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নিতেন। পরে সেই টাকা অবৈধ পথে (হুন্ডি) চক্রের ভারতীয় সদস্যদের কাছে পাঠাতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের চেন্নাই, মাদ্রাজ, রাজস্থান, দিল্লি ও বিহার প্রদেশ থেকে প্রতারকেরা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে নারীদের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ও অর্থশালী ব্যক্তিদের নিশানা করছেন। ভিডিও করার জন্য বাংলাদেশের ব্যক্তিকে যখন প্রতারক চক্রের সদস্যরা কল দেন, তখন নিজেরা কথা বলেন না। রেকর্ড করা অশ্লীল ভিডিও চালিয়ে দেন। কিন্তু তাঁরা এমন কৌশলে কাজটি করেন, যেন ভিডিও দেখে মনে হয় দুই পাশ থেকেই কথা বলা হচ্ছে।

ভারত–বাংলাদেশের নাগরিকেরা মিলে গড়ে তোলা প্রতারক চক্রের এই চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

ডিবির হাতে আসা তথ্যমতে, এই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছেন একটি মেডিকেল কলেজের শিশুবিশেষজ্ঞ, একজন সহকারী প্রকৌশলী, একটি পোশাক কারখানার মালিক, উত্তরাঞ্চলের একটি পৌরসভার মেয়র এবং বিশ্ববিদালয়শিক্ষার্থী। তাঁদের কাছ থেকে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ৫০ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন।

দুই দেশের নাগরিকদের মিলে প্রতারক চক্র গড়ে তোলার বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, চিকিৎসার প্রয়োজনে অনেকেই মাসের পরের মাস ভারতে গিয়ে অবস্থান করেন। আবার অনেকে ভ্রমণ করতে এবং ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে অবস্থানের সময় তাঁরাও সে দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন, কথাবার্তা বলেন। এভাবেই ভারতীয় প্রতারক চক্রের সঙ্গের বাংলাদেশি প্রতারকের পরিচয় হয়।

এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত দুই ভারতীয় নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে বলে ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যা বললেন ভুক্তভোগীরা

অনলাইনে এই প্রতারণার শিকার এক সরকারি কর্মকর্তা আজ প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকে প্রতিবেশী দেশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছ থেকে বন্ধুত্বের অনুরোধ পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেন। শুরুতে দুজনের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা চলতে থাকে। তবে কয়েক দিন পর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে কল এলে বাধে বিপত্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভিডিও কলে কোনো মানুষ নেই, অশ্লীল ছবি দেখতে পেলাম। দ্রুত কলটি কেটে দিলাম।’ কল কেটে দেওয়ার পাঁচ মিনিট পর তাঁর কাছে আরেকটি কল আসে। তখন বড় অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। তাদের চাহিদামতো টাকা না দিলে ধারণ করা ভিডিওটি বিকৃত করে আত্মীয়স্বজন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী আরেকজন বলেন, ‘এই প্রতারক চক্রের পাল্লায় পড়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা হয়ে আমার সংসার ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের কাছেও হেয় হয়েছি।’