ঢাকার শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম (টিপু) হত্যার পর এক ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ‘পরিকল্পনাকারী’ সুমন শিকদার ওরফে মুসার নির্দেশে ওই ব্যক্তি এই টাকা পাঠান।
ঘটনার পর ওই ব্যক্তিকে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তাঁর দেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় বগুড়া থেকে ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাসুমের দেওয়া তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আরও ২১ জনকে গ্রেপ্তার গোয়েন্দা পুলিশ।
অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে এসে ডিবি বলছে, মোবাইলে টাকা পাঠানো ওই ব্যক্তি হত্যার সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি মতিঝিল এলাকায় সুমন শিকদারের কেবল নেটওয়ার্কের ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। তবে তাঁর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে সহায়তা করেছে।
ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রিফাত রহমান শামীম প্রথম আলোকে বলেন, শাহজাহানপুরের জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে এই হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হবে।
গত ২৪ মার্চ রাতে শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলিতে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম নিহত হন। সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্যাসিনো কাণ্ডে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী এবং যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই দুজন গ্রেপ্তারের পর মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন জাহিদুল ইসলাম (টিপু)। শুরুতে তিনি অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। পরে এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
ডিবি জানায়, মতিঝিলের রাজনীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জিসান ও মানিকের সঙ্গে জাহিদুল ইসলামের দ্বন্দ্ব হয়। এর জেরেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এই হত্যায় কৌশলে ব্যবহার করা হয় জাহিদুলের অন্যতম সহযোগী রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামিদের। ২০১৬ সালে মতিঝিলের এজিবি কলোনি এলাকায় বোচা বাবু খুন হন।
জাহিদুল ইসলাম হত্যার আগে রাজধানীর রমনা এলাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও ক্লাবে বৈঠক হয়। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, একটি বৈঠকে গ্রেপ্তার সোহেল শাহরিয়ার তাঁর মুঠোফোন দিয়ে জিসানকে ফোন করে ফ্রিডম মানিককে কনফারেন্সে এনে সেখানে উপস্থিত সবার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিনের মধ্যে মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ ওরফে শুটার মাসুমকে গ্রেপ্তারের পর এই হত্যায় জড়িত অনেকের তথ্য জানা যায়। মাসুম আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জিসান, মানিক, মুসা ও মোল্লা শামীমের জড়িত থাকার তথ্য দেন।
হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দুবাই চলে যান। সেখানে বসেই ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটান। পরে তিনি দুবাই থেকে ওমানে যান। ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, এই হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি সুমন শিকদারকে ওমান থেকে গ্রেপ্তার করে দেশে আনতে পারা ছিল তদন্তের অন্যতম সফলতা। তাঁকে দেশে এনে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে হত্যার সঙ্গে কারা, কেন, কতটুকু জড়িত ছিল সে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যার পর যেভাবে পালিয়ে যান মাসুম ও মোল্লা শামীম
ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, ঘটনার দিন মতিঝিল থেকে জাহিদুল ইসলামের গাড়ি অনুসরণ করে খুনিরা। ভাড়াটে খুনি মাসুম এজিবি কলোনি এলাকাতেই জাহিদুলকে লক্ষ্য করে গুলি করতে চান। তবে মাসুমকে নিয়ে মোল্লা শামীম মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। তখন শামীম বলেন, এখানে গুলি করলে তাঁরা বেরোতে পারবেন না।
পরে শাহজাহানপুর পৌঁছালে গুলি করা হয়। এরপর দুজন রমনা হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে কারওয়ান বাজার আসেন। সেখান থেকে এফডিসি মোড়ের সামনে দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে গোড়ান ক্লাবে যান তাঁরা।