নতুন জঙ্গি সংগঠনের আরও তিন সদস্য গ্রেপ্তার
রাজধানীর নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার আরও তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ পর্যন্ত নিষিদ্ধ এই জঙ্গি সংগঠনের ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও পুলিশ।
র্যাব বলেছে, গ্রেপ্তার আবদুল হাদি ওরফে সুমন ওরফে জন (৪০) ও আবু সাঈদ ওরফে শের মোহাম্মদ (৩২) জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার অর্থ সরবরাহকারী।
আর গ্রেপ্তার রনি মিয়া (২৯) নিষিদ্ধ এই জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত। র্যাব আরও বলেছে, এ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া এক নারীকে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে এনে তাঁর পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। ওই মা তাঁর নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতে পাঠিয়েছেন। এখন তিনি ভুল বুঝতে পেরে তাঁর কিশোর ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি জানিয়েছেন।
গ্রেপ্তার তিন জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসা এ নারীর বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আজ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার আবদুল হাদি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি এক থেকে দেড় বছর আগে নিষিদ্ধ জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার শুরা সদস্য সৈয়দ মারুফ ওরফে মানিকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ছিলেন সংগঠনের ‘ক’ শ্রেণির অর্থদাতা। তিন মাস আগে তিনি সংগঠনের শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবকে সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য ৯ লাখ টাকা দেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানরত তাঁর দুই প্রবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় সহায়তার কথা বলে এসব টাকা সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া তিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা সংগঠনে চাঁদা দিতেন।
আবদুল হাদি দুই মাস আগে হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হন এবং অন্যান্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাহাড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু পাহাড়ে র্যাবের অভিযান চলতে থাকায় তিনি চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে এসে রনি মিয়ার সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলে হিজরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা রয়েছে। ওই মামলায় তিনি ১০ দিন কারাভোগও করেন।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন আরও বলেন, গ্রেপ্তার আবু সাঈদ অনলাইন শরিয়াহ গ্র্যাজুয়েশন ইনস্টিটিউট নামক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও তত্ত্বাবধানে যুক্ত ছিলেন। তিনি এক থেকে দেড় বছর আগে শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ছিলেন সংগঠনের ‘ক’ শ্রেণির অর্থদাতা। দুই মাস আগে রাকিবের কাছে সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য সাত লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া আবু সাঈদ প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতেন। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তাঁর শরিয়াহ ইনস্টিটিউট, মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় সহায়তার কথা বলে এই অর্থ সংগ্রহ করতেন। আবু সাঈদ এক মাস আগে পাহাড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। কিন্তু পাহাড়ে অভিযান চলমান থাকায় তিনি রনির মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় একত্র হন। তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়।
রনি মিয়া সম্পর্কে র্যাব বলছে, তিনি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পরে নারায়ণগঞ্জে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা করতেন। এক বছর আগে ছোটবেলার বন্ধু আল আমিন ওরফে আবদুল্লাহর মাধ্যমে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন রনি মিয়া। তিনি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম ও হিজরত করা সদস্যদের বান্দরবানসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। পার্বত্য অঞ্চলে র্যাবের অভিযান চলায় জঙ্গি সংগঠনটির যাঁরা পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছাতে পারছেন না, তাঁরা নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় রনির শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
র্যাবের পরিচালক খন্দকার মঈন বলেন, বিগত সময়ে নিরুদ্দেশ তরুণদের বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা নজরদারি করতে গিয়ে তথ্য পায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান নামক এক তরুণ গত মার্চ মাসে নিরুদ্দেশ হন। তাঁর পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় এ–সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর আগে র্যাবের প্রকাশ করা নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকায় আবু বক্করের নাম রয়েছে। যদিও র্যাব তাঁদের কাউকেই উদ্ধার করতে পারেনি। ৩ নভেম্বর র্যাব অভিযানের সময় সংগঠনের মহিলা শাখা সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং জানতে পারে, এক মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া তাঁর সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে পাঠিয়েছেন।
র্যাব বলেছে, সন্তানকে তথাকথিত হিজরতে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত এক মাকে ৫ নভেম্বর উদ্ধার করেছে তারা। ওই মা একটি নামকরা এয়ারলাইনসের ক্রু ছিলেন। ছেলের শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে তিনি ও তাঁর ছেলে আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথম দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই সংগঠনে যোগ দেন। পরে আবু বক্কর গত মার্চে আল আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হয় এবং সে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। অন্যান্য প্রশিক্ষণ শেষে গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আল আমিনের নির্দেশনায় গ্রেপ্তার রনি পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য আবু বক্করকে বান্দরবানে দিয়ে আসেন। আবু বক্কর পাহাড়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পর সন্তানের কোনো খোঁজখবর না পেয়ে চিন্তায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মা এবং ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন। পরে র্যাব সদস্যরা তার সন্ধান পেলে সন্তানকে ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন ওই মা। র্যাব ওই মাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ছেলেকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এ সময় ছেলেটির দেওয়া তথ্যমতে র্যাব রনি সম্পর্কে জানতে পারে।
র্যাব জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা থেকে বেশ কিছু তরুণ উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। র্যাব ওই বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে। ঘর ছেড়ে উগ্রবাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল চার তরুণকে উদ্ধার করে ডি-র্যাডিক্যালাইজড করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এ ছাড়া কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ এক তরুণ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। পরে বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে জাময়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।