‘আমি তোরে শেষ করতে চাইলাম, তুই আমারে শেষ করে দিলি’

স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন শাহনাজ পারভীন (৫০)। পরে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে রাজধানীর ওয়ারী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাঁর স্বামী।

চার বছর আগের ওই ঘটনার মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর শাহনাজ তাঁর স্বামীর হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করেন। তিনি খুব বিপদে আছেন বলে স্বামীকে জানান। পরে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রীর খোঁজে ঘটনাস্থলে যান ওই ব্যক্তি। সেখানে গিয়ে শুনতে পান, বাসায় খুন হয়েছে। পুলিশ গিয়ে দেখতে পায় শাহনাজ খাটের ওপরে বসে আছেন। নিচে যুবকের মরদেহ পড়ে আছে। সেই যুবকের নাম সজীব হাসান (৩২)। তিনি একটি পরিবহনের কাউন্টারে কাজ করতেন।

এ হত্যার ঘটনায় ওয়ারী থানায় মামলা হয়। সে মামলায় শাহনাজকে অভিযুক্ত করে ২০২১ সালের ৩১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এ মামলায় চার বছর ধরে শাহনাজ কারাভোগ করছেন। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭–এ বিচারাধীন।

গ্রেপ্তারের পর শাহনাজ আদালতকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে উঠে এসেছে, কেন তিনি সজীবকে খুন করেছেন। কীভাবে সজীবের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, তাঁদের মধ্যে কত বছর ধরে সম্পর্ক, সেসব তথ্য।

যেভাবে পরিচয়

মামলার কাগজপত্র ও আসামির স্বীকারোক্তির তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায়, বুটিক ব্যবসায়ী শাহনাজ স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় বসবাস করতেন। তাঁর কলেজপড়ুয়া ছোট মেয়েকে তিনি ক্লাস শেষে বাসায় নিয়ে আসতেন। কলেজের সামনে তিনি সজীব নামের এক যুবককে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতেন। একদিন দুজনের পরিচয় হয়। পরে দুজনের মধ্যে মুঠোফোন নম্বর বিনিময় ও কথা বলা শুরু হয়। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক গড়ে ওঠার কিছুদিন পর থেকে শাহনাজের স্বামী ও মেয়েদের সব বলে দেবে, এমন ভয় দেখিয়ে সজীব তাঁর (শাহনাজ) কাছ থেকে টাকা নিতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সজীব তাঁর জন্য কাছাকাছি এলাকায় একটি বাসা ঠিক করে দিতে চাপ তৈরি করেন। পরে দুজনে স্বামী–স্ত্রী পরিচয়ে ওয়ারীতে একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানে শাহনাজ নিজের পরিচয় দেন সাদিয়া আক্তার মৌ নামে এবং বলেন, তিনি পুলিশে চাকরি করেন। সপ্তাহে দু-তিন দিন তিনি ওই বাসায় যাতায়াত করতেন। বাসার ভাড়া পরিশোধ করতেন তিনি। আর বাসায় নিয়মিত থাকতেন সজীব।

শাহনাজকে স্ত্রী পরিচয়ে ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়িতে দু-তিনবার নিয়ে যান সজীব হাসান। দুজনের বয়সের ব্যবধান বেশি হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা এ সম্পর্ক মেনে নেননি। তবে সজীবের মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতেন শাহনাজ।

ব্যবসার (বুটিক) কথা বলে শাহনাজের ঘরের বাইরে যাওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে দেখতেন না তাঁর স্বামী। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। একই কারণে সেদিন (২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি) স্বামীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়। পরদিন ভোরবেলা শাহনাজ তাঁর স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে সজীবের সঙ্গে সেই ভাড়া বাসায় ওঠেন।

অতঃপর খুন

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে শাহনাজ বলেন, ‘২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আমি সজীবের বাসায় চলে আসি। ওই দিন সেখানে আমি থাকি। পরদিন সজীব আমার গয়না ও টাকা চায়। আমাকে বলেছিল, গয়না বিক্রি করে সিএনজি কিনবে। আমি গয়না ও টাকা দিতে চাইনি। তাই আমাকে গালিগালাজ করে।’

শাহনাজ স্বীকারোক্তিতে আরও বলেন, ‘১১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ভাত রান্না করি। সজীব সকালের নাশতা করে। আমার শরীর খারাপ থাকায় আমি শুয়ে থাকি। সজীব আমাকে নাশতা করতে বললে আমি তাকে বলি, ‘আমি ইনসুলিন নিয়েছি। পরে নাশতা করব।’ তখন সজীব বলে, ‘আখেরি খাবার খেয়ে নে।’ হঠাৎ সজীব আমার মাথায় বাড়ি মারে। এরপর বাঁ হাতে বাড়ি দিয়ে আঙুলগুলো উল্টে ধরে হাতটা তার পায়ের নিচে চেপে ধরে এবং বুকের ওপর চেপে বসে। একপর্যায়ে সে ছুরি দিয়ে আমার বুকে আঘাত করতে চায়। তখন আমি ছুরিটা কেড়ে নিয়ে সজীবকে ধাক্কা দিতেই সে খাট থেকে নিচে পড়ে যায়। এরপর তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছুরি দিয়ে আঘাত করি। একপর্যায়ে সে (সজীব) নিস্তেজ হয়ে যায়। সে বলে, ‘আমি তোরে শেষ করতে চাইলাম, তুই আমারে শেষ করে দিলি।’

শাহনাজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দাবি করেন, সজীব হাসানের আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এসব তথ্য জানার পর থেকে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন।

সজীব হাসানের খালা ও মামলার সাক্ষী নাজনীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সজীব হাসানের সঙ্গে শাহনাজ পারভীন কয়েকবার তাঁর বাসায় এসেছিলেন। দুজনের বয়সের পার্থক্য বেশি বলে তাঁরা সম্পর্কের বিষয়টি মেনে নেননি। তাঁরা সবাই এখন আসামি শাহনাজের সর্বোচ্চ সাজা চান।

আসামি শাহনাজ পারভীনের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে এসেছে। তিনি আশা করেন, তাঁর মক্কেল আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাবেন।