ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে অনেক স্কুলছাত্র 

কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের কারণ খুঁজতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ।

চট্টগ্রাম নগরে স্কুলছাত্রদের অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের অগোচরে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। যুক্ত হচ্ছে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের করা জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য।

চলতি বছরের শুরুতে নগরের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নগর পুলিশের বিশেষ শাখা (সিটিএসবি) এ জরিপ চালায়। এতে ভিত্তি ধরা হয় গত এক বছরের (২০২৩ সাল) উপস্থিতির হার। জরিপ চালানো হয় ৭৮২ জন শিক্ষার্থীর ওপর। তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নবম-দশম শ্রেণিতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি গড়ে ৪৬ শতাংশ। অনুপস্থিত থাকা ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ ছাত্র, যাদের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে। 

সিটিএসবি জানায়, নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা ও কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের কারণ খুঁজতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ। এসব ছাত্র পর্নোগ্রাফি, সাইবার অপরাধ, ছিনতাই, চুরি, মাদক নেওয়া ও কেনাবেচা এবং অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় স্কুলের সময়টা। এমনকি স্কুলের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। 

জানতে চাইলে সিটিএসবির উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু মামলায় পুলিশের তদন্তে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে দেখা গেছে নবম ও দশম শ্রেণির অনেক ছাত্রের অপরাধের শুরু হিরোইজম (বীরত্ব) দেখানো থেকে। প্রথমে চুরি-ছিনতাই ও মাদকের নেশায় জড়ায়। এরপর নেশার টাকা জোগাড় করা ও নানা অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে আশ্রয় নেয় এলাকাভিত্তিক বড় ভাইদের কাছে। বড় ভাইয়েরা অপরাধমূলক কাজে কিশোরদের ব্যবহার করেন। গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে অনেকে। অনেক সময় দেখা গেছে পরিবারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিশোর গ্যাংয়ের বড় ভাইদের সংস্পর্শে আসার পর আচরণেও নেতিবাচক পরিবর্তন হয়। 

নগর পুলিশের চার থানার ওসির সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া স্কুলপড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীকে অভিভাবকদের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা সংশোধনের সুযোগ পায়।

জানতে চাইলে জরিপ চালানো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশের বিভিন্ন বিপণিবিতান ও মাঠ থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে ধরে আনা হয়। তাদের নিয়মিত কাউন্সেলিংও করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, নগরে ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে তাদের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’।  গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।

খুদে বার্তা চালুসহ ৫ সুপারিশ 

জরিপে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়—নবম, দশম  ও একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির মোট ক্লাসের ন্যূনতম ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখা; যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার যৌক্তিক কারণে ৭০ শতাংশের নিচে থাকবে তাদের কারণ বিবেচনার জন্য শিক্ষা বোর্ডের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা; শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তা অভিভাবককে জানানোর জন্য এসএমএস (খুদে বার্তা) চালু ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় তাঁর কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিপথগামী হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ে। জরিপটি পাঁচটি সুপারিশসহ পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে আনবেন গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান পুলিশের সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, স্কুলে না গেলে কিশোরেরা এ সময়টাতে নিজের মতো করে যা খুশি করবে, বিভিন্ন গ্যাংয়ে জড়াবে। এতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়বে।