ঢাকায় বাসে ‘হারবাল ওষুধ’ খেয়েছিলেন তাঁরাও, কিন্তু মারা গেলেন অপর দুজন

বাসের মধ্যে হারবাল ওষুধের নামে চেতনানাশক খাওয়ার পর মারা যাওয়া শওকত ফকির ও আল ইমরান
ছবি: সংগৃহীত

বাস–লঞ্চে হরেক রকমের জিনিসপত্র বিক্রির জন্য লোভনীয় কথার ফুলঝুরি ঝরান বিক্রেতারা। এর মধ্যে রোগ সারানোর দাওয়াই হিসেবে গাছগাছড়ার গুণাগুণের বিবরণও তুলে ধরেন কেউ কেউ। অনেকেই তাঁদের কথার ফাঁদে পা দিয়ে এসব জিনিস কিনে থাকেন। এ রকমভাবে বাসের মধ্যে কথিত কবিরাজি ওষুধ খেয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। যাঁরা এটা দিয়েছিলেন, তাঁরা সাধারণ পণ্য বিক্রেতা নন, টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিশানা করে উঠেছিলেন বাসে। কবিরাজি ওষুধের নামে উচ্চ মাত্রার চেতনানাশক দিয়ে ওই ব্যক্তিদের অজ্ঞান করে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আশুলিয়া থেকে বাসে উঠে ‘কবিরাজি ওষুধ’ খেয়ে মারা গেছেন আল ইমরান (৪৫) ও  শওকত ফকির (৫৩) নামের দুজন ব্যক্তি। তাঁদের দুজনেরই বাড়ি গোপালগঞ্জে। ইমরান পরিবার নিয়ে থাকতেন টঙ্গীতে। আর শওকতের বাসা ছিল আশুলিয়ায়। বাসে চড়ে তাঁরা যাঁর যাঁর কর্মস্থলের পথে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু বাসের মধ্যে কথিত কবিরাজের প্ররোচনায় তাঁরা ওষুধ খেয়েছিলেন। অচেতন হওয়ার পর তাঁদের কাছে থাকা টাকাপয়সা নিয়ে সটকে পড়েন প্রতারকের দল। পরে দুজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পৃথক এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন মো. শামসুদ্দিন (৫৩), মো. নজরুল ইসলাম (৪৫), আকরাম আলী (৩৮) ও দেলোয়ার হোসেন (৪০)। তাঁদের মধ্যে আকরাম আদালতে ইমরান হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলা দুটি তদন্ত করছেন উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আনোয়ার হোসেন খান। তাঁরা বলছেন, এই প্রতারক চক্রের একাধিক সদস্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন টার্মিনালে থাকেন। তাঁরা কয়েকজন মিলে একটি বাসে যাত্রী হয়ে ওঠেন। পরে কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটব্যথাসহ নানা রোগের উপশম হিসেবে হারবাল ওষুধ বিক্রির প্রচার চালান। একপর্যায়ে ‘টার্গেট’ করা ব্যক্তিকে অতিরিক্ত চেতনানাশক মিশ্রিত ‘কবিরাজি ওষুধ’ খাওয়ান। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে তার সবকিছু নিয়ে কেটে পড়েন। শওকত ফকির ও ইমরান হত্যাকাণ্ডে এই চক্রই জড়িত।

ইমরানের মৃত্যুতে দিশাহারা পরিবার    

আল ইমরানের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ বছর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় আসেন ইমরান। বছর ১৫ আগে বিয়ে করেন। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে ইমরান টঙ্গীতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। চাকরি করতেন খিলক্ষেতের বাদল কটন ফিল্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে।

আল ইমরান
ছবি: সংগৃহীত

মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, গত ৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় আশুলিয়ার জিরাবো থেকে বিকাশ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন ইমরান। বাসটি যখন তুরাগের প্রত্যাশা সেতুর কাছে আসে, তখন কথিত কবিরাজ আকরাম আলী হারবাল ওষুধ বিক্রির প্রচার চালাতে থাকেন। একই বাসে ছিলেন শামসুদ্দিন, নজরুল ও দেলোয়ার। শামসুদ্দিন একপর্যায়ে ইমরানের পাশের আসনে গিয়ে বসেন। আকরাম যখন প্রচার চালাচ্ছিলেন, তখন শামসুদ্দিন ইমরানকে বলেন, ‘এই ওষুধ অনেক ভালো। এই ওষুধ আমি খেয়েছিলাম। অনেক ভালো ফল পেয়েছিলাম।’ এ সময় ওই দলের সদস্য নজরুলের কাছ থেকে দুটো বড়ি নিয়ে একটা শামসুদ্দিন চুষতে থাকেন, আরেকটা ইমরানকে দেন। একইভাবে আকরাম ও দেলোয়ারও ইমরানের সামনে ওই ট্যাবলেট খান।

এতে প্ররোচিত হয়ে ইমরান কথিত হারবাল ওষুধ খান। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তখন তাঁর কাছে থাকা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে নেন শামসুদ্দিন। পেছনের এক যাত্রী ইমরানের পকেট থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনা দেখে ফেলেন। তিনি হইচই করলে অন্য যাত্রীরা মিলে শামসুদ্দিনকে ধরে পুলিশে দেন।

এ সময় বাসযাত্রীরা গুরুতর অসুস্থ ইমরানকে মাথায় পানি ঢেলে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে বেলা পৌনে একটার তাঁকে উত্তরার লেক ভিউ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা দুইটার সময় তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

এ ঘটনায় ইমরানের স্ত্রী রুমপা খাতুন বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় কথিত হারবাল ওষুধ বিক্রেতা আকরাম হোসেনসহ চারজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আকরাম হোসেন আদালতে ইমরানকে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কথিত হারবাল ওষুধ বিক্রির নামে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে চেতনানাশক দ্রব্যাদি খাইয়ে তাঁদের কাছে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে আসছিল চক্রটি। এই চক্রের প্রধান মাদারীপুরের শামসুদ্দিন। চক্রের অনেক সদস্য ঢাকাজুড়ে এই অপকর্ম করে আসছেন।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ইমরানের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসার চালাতে দিশাহারা ইমরানের স্ত্রী রুমপা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সোনার সংসার তছনছ হয়ে গেল। আমার এক ছেলের বয়স ১১ বছর, অন্যজনের ৬ বছর। কীভাবে আমার সন্তানদের লেখাপড়া করাব, ভাবতে পারছি না। আমার পক্ষে আর শহরে থাকা সম্ভব হবে না।’

ইমরানের মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তাঁর স্ত্রী রুপমা খাতুন।

একই চক্রের হাতে ঠিকাদার শওকত খুন

স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আশুলিয়ায় বসবাস করতেন ঠিকাদার শওকত ফকির। তাঁর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মোকসেদপুরে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টায় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে আসার জন্য আশুলিয়ার জিরাব এলাকা থেকে ওয়েলকাম নামের একটি বাসে ওঠেন শওকত। পরে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে একজন নারী তাঁর পরিবারকে খবর দেন। পরে শওকতকে নিয়ে যাওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শওকতের ছোট ভাই মামুন ফকির বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আল ইমরান খুনে জড়িত চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, যে চক্রটি টঙ্গীর আল ইমরান হত্যায় জড়িত, সেই একই চক্র ঠিকাদার শওকত খুনে জড়িত রয়েছে। চক্রের অন্যতম সদস্য শামসুদ্দিন, আকরাম আলী, নজরুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেন। এর বাইরে আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। খুব শিগগির তাঁদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

শওকত ফকির
ছবি: সংগৃহীত

শওকতের ছোট ভাই মামুন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ের ছেলেটি উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর চাকরি খুঁজছে। মেয়েটা এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। ভাইয়ের এমন মৃত্যুতে পরিবারটি কীভাবে চলবে, তার কূলকিনারা হচ্ছে না।’

রাজধানীতে একই দিনে বাসের ভেতরে প্রতারণার শিকার হয়ে এভাবে দুজনের মৃত্যু অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্যের প্রমাণ দেয় বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলে নগরীতে এভাবে খুনি চক্র শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারত না। তাদের দুর্বলতার সুযোগেই নিরীহ দুজন মানুষ প্রাণ হারালেন।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান নূর খান। তিনি বলেন, এটা করা না গেলে ঢাকা শহরে অপরাধীদের এই নেটওয়ার্ক ভাঙবে না। একের পর এক নৃশংস অপরাধ ঘটতে থাকবে।