সিম বেচার সময় আঙুলের ছাপ চুরি, এখন তা অপরাধীদের হাতে, বিপাকে নিরীহ মানুষ

সিম বিক্রির সময় আলাদাভাবে মানুষের আঙুলের ছাপ রাখে অপরাধীরা। সেই ছাপ দিয়ে সিম কিনে অপরাধীদের কাছে বিক্রি হয়।

আঙুলের ছাপ
রয়টার্স ফাইল ছবি

সাধারণ মানুষের আঙুলের ছাপ এখন কেনাবেচা হয়। এক অপরাধী আরেক অপরাধীর কাছে সেই ছাপ বিক্রি করে। পরে চুরি করা আঙুলের ছাপ দিয়ে সিম তুলে অপরাধীদের কাছে বিক্রি করা হয়। বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ। অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া যায় না।

যেমন গত মাসে ফেসবুকে দেওয়া একটি বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে আঙুলের ছাপ চুরির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের ৩০ জনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে।

পুলিশের দাবি, নতুন সিম কিনতে ও পুরোনো সিমের পরিবর্তে নতুন সিম (রিপ্লেস) নিতে আসা মানুষের আঙুলের ছাপ কৌশলে চুরি করে সংরক্ষণ করতেন তাঁরা। এক ব্যক্তির আঙুলের ছাপের বিপরীতে যে সিম তোলা হতো, তা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

দেশে মুঠোফোনে ব্যবহারের মোবাইল অপারেটরদের সিম কিনতে আঙুলের ছাপ দিতে হয়। সঙ্গে লাগে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ফটোকপি ও ছবি।

২০১৫ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সিম কেনাবেচার ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করে, যাকে বলা হয় বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা। এখন দেখা যাচ্ছে, অপরাধীরা সাধারণ মানুষের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করছে। অপরাধের ঘটনায় সিমের সূত্র ধরে পুলিশ গিয়ে পাচ্ছে নিরীহ মানুষকে, যার নামে সিমটি নিবন্ধিত।

ফেসবুকে বিজ্ঞাপন

সিম বায়োমেট্রিক, কললিস্ট (বিবরণী) ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠানের তথ্য সরবরাহ করা হয়—ফেসবুকে গত মাসে এ ধরনের একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল অপরাধী চক্র। এটি নজরে আসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের। ‘ডিজিটাল সার্ভিস প্রো’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে বিজ্ঞাপনটি প্রচার করা হয়।

বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করে ডিবি। তারা জানতে পারে, চক্রটি সিম কিনতে ও বদলাতে আসা ব্যক্তিদের প্রথমে একবার আঙুলের ছাপ নিত। তারপরও গ্রাহককে বলা হতো, তাঁর আঙুল পরিষ্কার নয়। আবার ছাপ নিতে হবে। দ্বিতীয় ছাপটি নেওয়া হতো আরেকটি যন্ত্রে। চক্রের সদস্যদের একটি নিজস্ব অ্যাপ রয়েছে। সেই অ্যাপ ব্যবহার করে আঙুলের ছাপ নেওয়া ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংগ্রহ করা হতো। পরে ব্যক্তির অজান্তেই সিম তুলে অপরাধীদের কাছে বিক্রি করা হতো।

ঢাকা, কুড়িগ্রাম ও রংপুরে অভিযান চালিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর চক্রটির আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে কম্পিউটার, আঙুলের ছাপ সংগ্রহের সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ডিজিটাল যন্ত্র উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাধারণ গ্রাহকের নামে নিবন্ধিত সিম দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় অপরাধীদের কাছে বিক্রি করা হতো। একজনের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ১৩ থেকে ১৪টি সিম তোলা হতো। সিমগুলো বিক্রি করে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পাওয়া যেত। উল্লেখ্য, দেশে একজন মানুষের নামে এখন ১৫টি সিম নেওয়া যায়।

ডিবি সাইবার বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েত আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছে সাধারণ মানুষের আট শ আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। দুই বছর ধরে চক্রের সদস্যরা এভাবে আঙুলের ছাপ ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে আসছিলেন। চক্রের বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার মো. মাসুদ (২২) এই চক্রের প্রধান। তিনি এইচএসসি পাস করে একটি মোবাইল অপারেটরের বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর) পদে চাকরি শুরু করেন। তাঁর তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা রয়েছে। মাসুদের সহযোগী মেহেদী হাসান (২৪) অ্যাপ ও সফটওয়্যার তৈরি করতে পারেন।

মাসুদকে আঙুলের ছাপ পেতে সহযোগিতা করতেন ইমন হোসেন (২৫) ও মো. শাকিল (২৫), যাঁরা একটি মোবাইল অপারেটরের বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। পুলিশ বলছে, এই দুজন মানুষের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে মাসুদের কাছে বিক্রি করতেন। চক্রের আরেক সদস্য নুর আলমের (২৪) কাজ ছিল মানুষের আঙুলের ছাপসহ ব্যক্তিগত তথ্য কেনা। তিনি আল আমিন (২৬) ও আরাফাত রহমান (২৩) নামে দুই ভাইয়ের কাছ থেকে এসব তথ্য কিনতেন। আল-আমিন ও আরাফাত একটি মোবাইল অপারেটরের রংপুরের পীরগঞ্জের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে কাজ করতেন।

মোবাইল অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার (অব.) প্রথম আলোকে বলেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালুর পর সিমসংক্রান্ত জালিয়াতি অনেক কমে এসেছিল। তবে নতুন উপায়ে আবারও এমন ঘটনা ঘটে থাকলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও গ্রাহকসচেতনতা বাড়িয়ে এ ধরনের অপরাধ কমাতে হবে।

এক কেজি আটার বিনিময়ে আঙুলের ছাপ

বিশ্বজুড়ে সাধারণ সাইবার অপরাধের একটি ধরন হলো পরিচয় চুরি বা আইডেনটিটি থেফট। দেশে ডিজিটাল সেবার বিস্তার ঘটানো হয়েছে, কিন্তু নাগরিকদের সচেতনতার উদ্যোগ কম। এই সুযোগই নিচ্ছে অপরাধীরা। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে অসচেতন নাগরিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে আঙুলের ছাপসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রহ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

যেমন ঢাকার মিরপুর থানার একটি প্রতারণা মামলায় একটি সিম শনাক্ত করে পুলিশ। দেখা যায়, সিমটি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর বাসিন্দা ফারাজুল হকের নামে নিবন্ধিত। তিনি একজন কৃষক। পুলিশ বলছে, ফারাজুলের আঙুলের ছাপ ও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে একটি সিম নেওয়া হয়। সেই সিমে মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএসএফ) হিসাব খোলা হয়। হিসাবটিতে অপরাধের বিপুল অর্থ লেনদেন করা হয়েছে।

ফারাজুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, ২০২২ সালের জুনে দুজন তাঁদের গ্রামে যান। তাঁরা সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা বলে তাঁর ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙুলের ছাপ নেন। বিনিময়ে তাঁকে এক কেজি আটা দেওয়া হয়।

ফারাজুল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছ থেকে একাধিকবার আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করছে না, তাই একাধিকবার নিতে হচ্ছে।

পুলিশ বলছে, একই কায়দায় আঙুল ছাপ নেওয়া হয় নাটোরের রূপালী বেগম (৪৪), পাবনার আনোয়ার শেখ (৭৭), ঠাকুরগাঁওয়ের নাসিমা (৪৪), নাটোরের আফরোজা বেগমসহ (৪৬) অনেকের।

ফরিদপুরের ভেদরগঞ্জ ও দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের দুই গ্রামে বিনা মূল্যে সিম দেওয়ার কথা বলে মানুষের আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছবি (আইরিশ) চুরির ঘটনা ঘটে গত বছর।

অপরাধীদের খুঁজতে গিয়ে সিমের সূত্র ধরে পুলিশ যে নিরীহ মানুষের বাড়িতে যায়, তার উদাহরণ আফরোজা বেগম। নাটোরের এই গৃহিণী গতকাল সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে বাড়িতে পুলিশ এসে বলেছে, আমার নামের সিম দিয়ে নাকি অপরাধীরা অপরাধ করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি তো এসব কিছু জানি না। সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে কিছু লোক তো আমাদের গ্রামের অনেকের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও আঙুলের ছাপ নিয়েছে।’

এক নামে ১৫টি সিম কেন

দেশে এখন মোবাইল অপারেটর চারটি। আবার নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলের সুযোগও রয়েছে। তারপরও একজন মানুষের নামে ১৫টি সিম নিবন্ধন করা যায়।

আঞ্চলিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা সংস্থা লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাইদ খান প্রথম আলোকে বলেন, একজন মানুষের নামে ১৫টি সিম নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ার এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। এটি পাঁচটিতে নামিয়ে আনা উচিত। আর সরকারের একটি পথনকশা থাকা উচিত, যেখানে বলা হবে কত বছরের মধ্যে একজন মানুষের নামে দুটির বেশি সিম দেওয়া হবে না।