তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন
গোপন বন্দিশালা পরিচালিত হয় ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ নামে
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ নামে দুটি গোপন বন্দিশালার বিস্তারিত উঠে এসেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গুমের আলামতগুলো ধ্বংস করা হয়েছে বলে উঠে আসে কমিশনের প্রথম প্রতিবেদনে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব গোপন বন্দিশালায় গুম শিকার হওয়া ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো, সেগুলোর মধ্যে দুটির সাংকেতিক নাম ছিল ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’। এ দুটি বন্দিশালা পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিল র্যাবের গোয়েন্দা শাখা।
উত্তরার র্যাব-১ কার্যালয়ের চত্বরে থাকা টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন বা টিএফআই সেল হিসেবে পরিচিত বন্দিশালার সাংকেতিক নাম ছিল হাসপাতাল। এটি র্যাব সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হতো। তবে সুনির্দিষ্টভাবে দেখভাল করত র্যাবের গোয়েন্দা শাখা।
সাংকেতিক নাম ‘ক্লিনিক’ হিসেবে পরিচালিত বন্দিশালাটির অবস্থান ছিল র্যাব সদর দপ্তরের চত্বরেই। কাচঘেরা কাঠামো হওয়ায় এই বন্দিশালাটিকে ‘গ্লাস হাউস’ নামেও ডাকা হতো।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ দুটি গোপন বন্দিশালার বিস্তারিত উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করছে। গত ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছিল কমিশন। সেই প্রতিবেদনে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা উঠে আসে।
‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ সাংকেতিক নামে পরিচালিত গোপন বন্দিশালা পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিল র্যাবের গোয়েন্দা শাখা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কীভাবে গুমের আলামতগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, তা–ও উঠে আসে প্রথম প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) পরিচালিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলসহ (জেআইসি) বিভিন্ন সংস্থায় ৫ আগস্টের পর গুমের আলামত ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে।
টিএফআই সেলটি তিনটি আলাদা অংশে বিভক্ত ছিল। একটি প্রশাসনিক এলাকা, একটি বৃহত্তর বন্দিশালা এবং একটি ছোট এলাকা, যা নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ব্যবহৃত হতো।
দ্বিতীয় প্রতিবেদনে পূর্বের ঘটনার সারাংশ তুলে ধরে বলা হয়, অনুসন্ধান যত এগিয়েছে, ততই আরও নতুন নতুন প্রমাণ ধ্বংসের ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ নামে র্যাব পরিচালিত দুটি গোপন বন্দিশালার অনেক আলামতও সরকার পতনের পর ধ্বংস করা হয়। অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই এ কাজ করে। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়, তদন্তকাজে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং সময়ক্ষেপণ হয়। পরে ভুক্তভোগীদের বর্ণনা অনুযায়ী বন্দিশালাগুলো শনাক্ত করা হয়।
‘হাসপাতাল’–এর খোঁজ যেভাবে
২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মীর আহমদ বিন কাসেমকে (ব্যারিস্টার আরমান) মিরপুর ডিওএইচএস থেকে গুম করার কথা জানায় পরিবার। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ছেলে। গোপন বন্দিশালা থেকে গত ৬ আগস্ট পরিবারের কাছে ফেরেন আরমান। মূলত তাঁর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী বন্দিশালা হাসপাতালের খোঁজ পায় তদন্ত কমিশন।
অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (অপারেশনস) পদে পরিবর্তন আসে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। নতুন কর্মকর্তার অধীনেও প্রমাণ ধ্বংসের কাজ অব্যাহত ছিল। পরে গোয়েন্দা শাখার পরিচালককে সরিয়ে একজন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিয়োগ করা হলেও তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা থেকে যায়।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে খবর ছিল, ব্যারিস্টার আরমান ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘরে’ (জেআইসি) আটক ছিলেন। কিন্তু তিনি যে সেখানে ছিলেন না, এ বিষয়ে প্রথম ইঙ্গিত মেলে তাঁরই সাক্ষ্য থেকে। কারণ, প্রতিটি বন্দিশালার নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ করে প্রহরীদের আচরণ, শৌচাগার ব্যবহারের সময়সূচি, পরিবেশের শব্দ, পরিবেশিত খাদ্যের ধরন এবং অন্যান্য সংবেদনশীল সংকেত দিয়ে একটি বন্দিশালাকে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু আরমান যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তার সঙ্গে ডিজিএফআইয়ের বন্দিশালার পরিচিত বৈশিষ্ট্যগুলোর অসামঞ্জস্যতা স্পষ্ট হয়। ডিজিএফআইয়ের বন্দিশালায় আটক থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমীর (গোলাম আযমের ছেলে) সঙ্গে তাঁর বর্ণনা মিলছিল না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই দ্বন্দ্ব দূর করতে আরমানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ধীরে ধীরে তাঁর বর্ণনায় এমন কিছু বিষয় উঠে আসে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তাঁকে আসলে র্যাব সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত র্যাব-১ প্রাঙ্গণে অবস্থিত টিএফআই সেলে আটকে রাখা হয়েছিল। গত ১৬ অক্টোবর প্রথমবার ওই টিএফআই সেল পরিদর্শন করলে কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি অন্তত দুই বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এই দাবি তখন কিছুটা বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে কমিশনের। কারণ, স্থাপনাটি জরাজীর্ণ, অবকাঠামো ভাঙাচোরা এবং পুরো এলাকা দীর্ঘকাল অযত্নে পড়ে থাকার ছাপ রয়েছে।
টিএফআই সেলটি তিনটি আলাদা অংশে বিভক্ত ছিল। একটি প্রশাসনিক এলাকা, একটি বৃহত্তর বন্দিশালা এবং একটি ছোট এলাকা, যা নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ব্যবহৃত হতো। ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনা নির্যাতন এলাকার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। পরে কমিশন বুঝতে পারে, নির্যাতন শাখার একটি ছোট অংশ দীর্ঘমেয়াদি বন্দীদের আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে খবর ছিল, ব্যারিস্টার আরমান ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা আয়নাঘরে (জেআইসি) আটক ছিলেন। কিন্তু তিনি যে সেখানে ছিলেন না, এ বিষয়ে প্রথম ইঙ্গিত মেলে তাঁরই সাক্ষ্য থেকে।
যেমন আরমান বলেছিলেন, তাঁর পায়ের নিচে থাকা মেঝেটি ছিল ঠান্ডা এবং টাইলস করা। কিন্তু কমিশনের সদস্যরা যখন সেই স্থানে যান, তখন মেঝে ছিল অসমান ও রুক্ষ সিমেন্টের, যা অনেক আগে থেকেই পড়ে ছিল। এটিই ছিল সন্দেহের কারণ। কমিশন দেখতে পায়, মেঝেতে বর্গাকৃতির চিহ্ন রয়েছে, যা পরিত্যক্ত টাইলসের চিহ্ন হতে পারে। এরপর টাইলসের খোঁজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
বন্দিত্বকালীন অধিকাংশ সময় আরমানের চোখ বাঁধা ছিল। তবে অন্য অনেক বন্দীর মতো তিনি দিকনির্দেশনা ও চলাচলের স্মৃতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিতে পেরেছিলেন। সেই অনুযায়ী তাঁকে একটি মানচিত্র একে দিতে বলে তদন্ত কমিশন। ওই মানচিত্র থেকে কমিশনের সন্দেহ আরও জোরদার হয়। এরপর আরমান তাঁর কাছে পাঠানো একটি ছবি থেকে ধারণা করেন, এ অংশে তাঁর কক্ষের দরজা ছিল, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ অনুসন্ধানের গতিপথ পাল্টে দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কমিশন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের একটি নকশা পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট দেয়ালের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিমাপ তুলনা করার অনুরোধ করা হয়। এই পরিমাপের পর অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়, এটি পরিত্যক্ত থাকার তথ্য সঠিক নয়। এরপর দেয়াল ভাঙলে একেবারে অক্ষত অবস্থায় থাকা একটি গোপন কক্ষ পাওয়া যায়, যা ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। তখন কমিশন নিশ্চিত হয় যে আট বছরের অধিক সময় আরমান ওই গোপন কক্ষে বন্দী ছিলেন।
ক্রমাগত ধ্বংস করা হয় প্রমাণ
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, টিএফআই সেলের গোপন কক্ষ আবিষ্কারের পর কমিশন প্রমাণ ধ্বংসের সময়রেখা নিয়ে আরও অনুসন্ধান চালায়। এরপর কমিশন নিশ্চিত হয়, এই স্থানটিতে ধ্বংস ও গোপন করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই। এরপর সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে তা চলমান ছিল।
কমিশনের সদস্যদের সরাসরি ও পরোক্ষ—উভয়ভাবেই ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটেছে। ব্যক্তিগতভাবে, মুঠোফোনের মাধ্যমে এবং অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এসব হুমকি দেওয়া হয়।
র্যাবের ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব পরিবর্তনের পরও আলামত ধ্বংস বন্ধ হয়নি, এমন উদাহরণ রয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। বলা হয়, র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন পরিচালক ৫ আগস্টের আগে থেকে ১৬ অক্টোবর কমিশনের পরিদর্শনের সময়ও একই পদে বহাল ছিলেন। তবে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (অপারেশনস) পদে পরিবর্তন আসে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। নতুন কর্মকর্তার অধীনেও প্রমাণ ধ্বংসের কাজ অব্যাহত ছিল। পরে গোয়েন্দা শাখার পরিচালককে সরিয়ে একজন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিয়োগ করা হলেও তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা থেকে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাবের নতুন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের মতো কর্মকর্তারা, যাঁরা সরাসরি পূর্বের অপরাধে জড়িত ছিলেন না, তাঁরা এখন একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে পূর্বসূরিদের অপকর্ম আড়াল করতে গিয়ে নিজেরাও নতুনভাবে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এর আইনগত পরিণতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে বলে মনে করে কমিশন।
সদর দপ্তরেই বন্দিশালা ‘ক্লিনিক’
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাব গোয়েন্দা শাখা গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত আরেকটি গোপন বন্দিশালা পরিচালনা করত। র্যাবে ‘ক্লিনিক’ নামে পরিচিত এ বন্দিশালার অবস্থান ছিল র্যাব সদর দপ্তরের চত্বরের মধ্যেই। এর তৃতীয় তলায় একসময় প্রায় ছয়টি ছোট বন্দিশালা ছিল।
গত এপ্রিলে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে গ্লাস হাউসটি চিহ্নিত করা হয় বলে জানায় কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, চিহ্নিত করার আগপর্যন্ত তারা শুধু অনুমান করছিল যে বিমানবন্দর–সংলগ্ন কোনো স্থানে র্যাব গোয়েন্দা পরিচালিত একটি বন্দিশালা থাকতে পারে, যেটি তখনো শনাক্ত হয়নি। পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, এর অভ্যন্তরীণ বিন্যাসে অনেক কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিন্যাস আর ভুক্তভোগীদের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলছিল না। তবে ছাদের বিমের অবস্থান, বিভাজক দেয়ালের চিহ্ন এবং কিছু অবশিষ্ট দেয়ালচিত্র দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মূলত এটি ছয়টি পৃথক কক্ষ নিয়ে গঠিত ছিল। পরিদর্শনের সময় সেখানে চারটি কক্ষ ছিল। দুটি বিভাজক দেয়াল সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট অংশে নতুন টাইলস বসিয়ে বাথরুমের মতো ইন্টেরিয়র তৈরি করা হয়েছে। মূল দরজাগুলো সরিয়ে ফেলায় পুরো কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
আলামত ধ্বংসের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্ষের দেয়াল অপসারণ এবং পুনর্গঠনের ধরন দেখে স্পষ্ট হয়, তড়িঘড়ি করে এটা করা হয়নি। এর সময়কাল ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ইঙ্গিত দেয় যে এতে নির্দিষ্ট বরাদ্দ ও পরিকল্পনা ছিল।
প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, টিএফআই সেল থেকে নির্যাতনে ব্যবহৃত সামগ্রীগুলো যখন অপসারণ চলছিল, সেই সময়ে সদর দপ্তরে থাকা বন্দিশালার প্রমাণও ধ্বংস করা হয়। অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে যে এসব নির্যাতন যন্ত্র—যেমন ঘূর্ণনশীল চেয়ার, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ডিভাইস এবং একটি নির্যাতন যন্ত্র একই সময়ে সরিয়ে ফেলা হয়।
পৃথকভাবে র্যাব গোয়েন্দা শাখা পরিচালিত আরও দুটি সেফ হাউস—একটি উত্তরায় এবং অপরটি মিরপুরে। ৫ আগস্টের অনেক আগেই নিষ্ক্রিয় তা করা হয়েছিল। পরিদর্শন এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমিশন মনে করছে, উক্ত দুটি স্থান পূর্বেই ভেঙে ফেলা হয়েছে।
তদন্তকারীদের হুমকি, তদন্তে বাধা
কমিশনের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে, তা ছিল বহুমাত্রিক এবং অনেক সময়ে গভীরভাবে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ বলেও অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনের সদস্যদের সরাসরি ও পরোক্ষ—উভয়ভাবেই ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটেছে। ব্যক্তিগতভাবে, মুঠোফোনের মাধ্যমে এবং অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এসব হুমকি দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কর্মকর্তাই অভিন্ন ভাষায় দায় অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তাঁরা উক্ত ভবনটির অস্তিত্ব জানতেন না কিংবা সেখানে বন্দীর উপস্থিতির বিষয়ে কিছুই জানেন না।
কমিশনের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে হয়রানি, অপপ্রচার ও পরিকল্পিত তথ্যবিকৃতির শিকার হয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে যে তাঁরা নাকি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, যেমন আইএসআই, র অথবা সিআইএর গোপন এজেন্ট, কিংবা ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক চরমপন্থী। কিছু সাক্ষাৎকারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে তাঁরা কমিশনের সদস্যদের পরিবারের ওপর নজরদারি চালাচ্ছেন।
এ ধরনের ভয়ভীতি কমিশনের কাজের গতিপথ বা গতি কোনোভাবেই ব্যাহত করতে পারেনি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দায়িত্ব ও ভুক্তভোগীদের প্রতি প্রতিশ্রুতি থেকে সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে কমিশন কাজ চালিয়ে গেছে।
ভয়ভীতির বাইরেও কমিশন নিয়মিত প্রক্রিয়াগত বাধার সম্মুখীন হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই স্পষ্টভাবে সংবেদনশীল তথ্য লিখিত আকারে দিতে অনীহা দেখিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রশ্নের জবাব পেতে সপ্তাহ, এমনকি মাস পর্যন্ত লেগে গেছে। কর্মকর্তাদের তালিকা, যানবাহনের লগবই, মোতায়েন ইতিহাস বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিচয়; যেমন কোনো ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট স্থাপনার তত্ত্বাবধানে ছিলেন—এ ধরনের তথ্যের জন্য অনুরোধ জানালে দীর্ঘ নীরবতা, বিলম্ব কিংবা অস্পষ্ট জবাবের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
প্যারাসিটামল পেতেও অনুমোদন লাগত
কমিশন জানিয়েছে, অনুসন্ধানে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে গুমের পুরো সময়ে র্যাব একটি সুসংহত ও কেন্দ্রীভূত নির্দেশনা কাঠামো বজায় রেখেছে। এমনকি ক্ষুদ্রতম সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যও উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। উদাহরণস্বরূপ, টিএফআই সেলে কোনো বন্দী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে প্যারাসিটামল দিতে হলেও অনুমতি নিতে হতো।
কমিশন বলছে, এ ধরনের তথ্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারি এই কর্মকাঠামোর বৈশিষ্ট্য ছিল। ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব শুধু প্রশাসনিক নয়, কার্যকর পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সরাসরি নিয়োজিত ছিলেন।
আলামত নষ্টের দায় অস্বীকার
গত কয়েক মাসে কমিশন বেশ কিছু কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কর্মকর্তাকে ডাকা হবে। প্রতিবেদনে টিএফআই সেলের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কর্মকর্তাই অভিন্ন ভাষায় দায় অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তাঁরা উক্ত ভবনটির অস্তিত্ব জানতেন না কিংবা সেখানে বন্দীর উপস্থিতির বিষয়ে কিছুই জানেন না।
গত অক্টোবরে কমিশনের সদস্যদের টিএফআই সেল পরিদর্শনের সময় তাঁদের স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছিল এবং তাঁরা দেখেছেন, তৎকালীন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক ওই ভবনের চাবি তাঁর দখলে রেখেছিলেন। অর্থাৎ ভবনটি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল এবং কখনোই গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি এমন দাবি নিছক বিভ্রান্তিকর। বিশেষ করে ব্যারিস্টার আরমানকে ওই স্থান থেকেই মুক্তি দেওয়া হয়েছে—এই তথ্য তাৎপর্যপূর্ণ ও অখণ্ড প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
কমিশনের কাছে আরও কিছু প্রামাণ্য উপকরণ আছে যা নির্দেশ করে র্যাবের মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক স্তরেও টিএফআই সেলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এই তথ্যগুলো কমিশনের চলমান তদন্ত এবং ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রয়োজনে পরবর্তী ধাপে প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনে একটি উদাহরণ উল্লেখ করে বলা হয়, একটি গোপন বন্দিশালায় কমিশনের সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শন ও আলোকচিত্রভিত্তিক প্রমাণ সংগ্রহের পর সংশ্লিষ্ট সংস্থা লিখিতভাবে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। কিন্তু সরাসরি ফলোআপ যোগাযোগ ও অখণ্ড প্রমাণ উপস্থাপনের পর সংস্থাটি শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান প্রত্যাহার করে এবং স্থানটির অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
বিচার সম্ভব
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা এমন কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাক্ষ্যও পেয়েছে, যাঁরা গুমের ঘটনার সময়ে গোপন বন্দিশালা টিএফআই সেলে কর্মরত ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন ব্যক্তির আটক থাকার কথা স্বীকার করেছেন। সুতরাং, টিএফআই সেল বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল—এই দাবি যে স্পষ্টতই অসত্য, কমিশন তা যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ফলে উক্ত ভবনে সংঘটিত ঘটনা-ব্যবস্থাপনার অধীনে সংঘটিত দীর্ঘমেয়াদি গুম এবং পদ্ধতিগত অমানবিক নির্যাতনের জন্য এসব কর্মকর্তারা দায়ী। এ ধরনের প্রমাণ সমৃদ্ধ এবং ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের মামলা (যেমন আরমানের) জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বিন্দু তৈরি করে।
এই মামলায় দায়ী বহু কর্মকর্তা সেই একই সময়ে র্যাব গোয়েন্দা শাখা পরিচালিত অপর গুমের ঘটনাগুলোরও দায়িত্বে ছিলেন, যেগুলোর ভুক্তভোগীরা আজও নিখোঁজ। ফলে ব্যারিস্টার আরমানের মতো মামলায় দায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কমিশন দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে আঘাত হানতে পারে। কমিশন বলছে, এ ঘটনা প্রমাণ করে, বিচার সম্ভব এবং ক্ষমতাবানেরাও বিচারের আওতার বাইরে নন।