মানব পাচারের ৩১৬ মামলার সব আসামি খালাস

সঠিকভাবে মামলা তদন্ত না করা, মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে আপস–মীমাংসার কারণে খালাস পাচ্ছেন আসামিরা।

মানবপাচারপ্রতীকী ছবি

কানাডায় পাঠানোর কথা বলে সাভারের একজন নারীকে (২৮) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় পাচার করা হয়। সেখানে একটি জেলে সাত মাস বন্দী থেকে দেশে ফেরেন তিনি। এ ঘটনায় তাঁর বাবা বাদী হয়ে যে মামলা করেছিলেন, সেই মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন।

মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা বলেন, সঠিকভাবে মামলা তদন্ত না করা, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারা এবং মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে আপস–মীমাংসার কারণে আসামিরা খালাস পাচ্ছেন। এ কারণে মানব পাচার প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী। ফাইল ছবি
মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। তাঁরা ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আপস–মীমাংসা করে ফেলেন।
সালমা আলী, সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

কেবল এই নারী নন, মানব পাচারের শিকার অনেক ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করে বিচার পাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গত বছরের (২০২৩) নভেম্বর মাসের মানব পাচার–সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর—এই ৯ মাসে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে করা ৩৩২ মামলার বিচার বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৬ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন, যা মোট মামলার ৯৫ দশমিক১৮ শতাংশ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ১২ হাজার ২৭৯ আসামি খালাস পেয়েছেন। যে ১৬ মামলায় ৫৬ জনের শাস্তি হয়েছে, তার মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে মাত্র দুজনের।

সাভারের ভুক্তভোগী নারীর বাবা ও মামলার বাদী আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতে গিয়ে আমার মেয়ে সাত মাস জেল খাটল। আমি মামলা করার পর আসামিরা উল্টো আমার বিরুদ্ধে সাভার থানায় ভুয়া মামলা করেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আমিও চার মাস জেল খাটলাম। পাঁচ-থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাবা-মেয়ে জেল খেটেছি। এখন শুনছি আমার মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন।’

তথ্যের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছি। সেই তথ্যগুলো এখনো পাওয়া যায়নি।
হাতিরঝিল থানার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আসআদ বিন আব্দুল কাদির

এই বাবা আরও বলেন, জেল খেটে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তিনিও মামলার খোঁজখবর রাখতে পারেননি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁকে অনেকবার আদালতে সাক্ষী দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও কখনো নিয়ে যাননি। মামলার দুই আসামি খালাস পেয়ে এখন এলাকায় আছেন।

ওই তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি তাঁর কাছ থেকে অনেক আগেই সিআইডিতে চলে গেছে। আর কোনো হালনাগাদ তথ্য তাঁর কাছে নেই।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১ ও ২০২২ সালে একটি মামলাতেও সাজা হয়নি আসামিদের। তাই মামলা তদন্তে সম্প্রতি একটি নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিদেশে যাওয়া থেকে মানব পাচারের শিকার হয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত ছয়টি পর্যায়ে অপরাধ সংঘটিত হয়। সেই নির্দেশনাগুলোয় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির মাধ্যমে ভুক্তভোগী মানব পাচারের শিকার হয়েছে, কার মাধ্যমে তিনি এই চক্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, ভুক্তভোগীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, জোরপূর্বক অপহরণ করে বা তাঁর কোনো অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পাচার করা হয়েছে কি না, এসব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এ ছাড়া পাচারকারী চক্র ভুক্তভোগীকে কোন পথে পাচার করেছে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এসব বিষয়কে মামলা তদন্তের সময় গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে।

ভারতে গিয়ে আমার মেয়ে সাত মাস জেল খাটল। আমি মামলা করার পর আসামিরা উল্টো আমার বিরুদ্ধে সাভার থানায় ভুয়া মামলা করেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আমিও চার মাস জেল খাটলাম। পাঁচ-থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাবা-মেয়ে জেল খেটেছি। এখন শুনছি আমার মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন
সাভারের ভুক্তভোগী নারীর বাবা ও মামলার বাদী

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মাসে মানব পাচারের নতুন মামলা হয়েছে ৬৮৩টি। এর মধ্যে ৩১টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১৮টি মামলার। এ সময় নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৯টি মামলা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে করা ৩০ হাজার ৫৩৯টি মামলার মধ্যে ২৫ হাজার মামলা বিচারাধীন। তদন্তাধীন রয়েছে আরও ৫ হাজার ৩২৭টি মামলা। ২ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মানব পাচার মামলায় আসামি খালাস হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারের মামলা পুলিশের কাছে খুবই লাভজনক মামলা। তদন্ত কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী ও আসামি উভয় পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তদন্ত দীর্ঘদিন আটকে রাখেন। তিনি বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। তাঁরা ভুক্তভোগীদের হুমকি–ধমকি দিয়ে আপস–মীমাংসা করে ফেলে। ফলে আসামিদের শাস্তি হয় না। তাই মানব পাচার প্রতিরোধেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা।

মামলা তদন্তে ধীরগতি

অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ২০২২ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবে যান নারায়ণগঞ্জের ৩৪ বছর বয়সী এক নারী। মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতনে বাসায় কাজ করার কথা বলে তাঁকে বিদেশে পাঠান মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। সেখানে গিয়ে বাসায় কাজের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পরে মুঠোফোনে পরিবারকে নির্যাতনের কথা জানান তিনি।

এই নারীর স্বামী বলেন, ‘নির্যাতনের কথা শুনে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার জন্য যাঁদের মাধ্যমে সৌদি গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁরা ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। সেখানে আমার স্ত্রী আত্মহত্যার হুমকি দিলে তাঁকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে দেশে ফিরে আসেন তিনি।’

তিনি বলেন, এ ঘটনায় ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর হাতিরঝিল থানায় সাইফুল ইসলাম, মো. রুবেল ও মো. মালেক নামের তিন পাচারকারীর নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। সেই মামলার তদন্ত পুলিশ এখনো শেষ হয়নি।

তদন্ত শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে হাতিরঝিল থানার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আসআদ বিন আব্দুল কাদির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছি। সেই তথ্যগুলো এখনো পাওয়া যায়নি।’

টিকটকের নামে ভারতে নারীদের পাচার করে আসছিল একটি চক্র। পাচারের শিকার হওয়া এক তরুণী ২০২১ সালের ৭ মে ভারত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি ১ জুন হাতিরঝিল থানায় পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে পাচারের ঘটনায় জড়িত ছিলেন ‘টিকটক হৃদয়’ নামে পরিচিত রিফাদুল ইসলাম ওরফে হৃদয় (২৬)। তিন বছর শেষ হলেও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। অথচ একই ঘটনায় ভারতে গ্রেপ্তার আসামিদের বিচার হয়ে শাস্তি ও হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, হাতিরঝিল থানায় ওই তরুণীর মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। অথচ একই ঘটনায় ভারতের আদালতে আসামিদের অনেক আগেই শাস্তি হয়েছে। তদন্ত–সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি না থাকায় আসামিদের যথাযথ সাজা হচ্ছে না।